আলজাজিরার ডকুমেন্টারি ও আমাদের সাংবাদিকতা

গত পরশু দিন বিবিসিতে একজন উইঘুর নারীর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ইনভেস্টিগেটিভ  রিপোর্ট হয়েছিল- এই নারী একটি  চাইনিজ ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন সেখানে একটি রুম আছে যে রুমে নারীদেরকে আলাদা ভাবে নিয়ে যাওয়া হয় এবং চাইনিজ অফিসাররা তাদের ধর্ষণ করে। এবং বেছে বেছে সুন্দর নারীদের ধর্ষণ করা হয়।

দা গোল ইজ টু ডিস্ট্রয় এভ্রিওয়ান নামের এই রিপোর্ট, বিবিসির কাছে এই নারীর বক্তব্য বাদে আর কোন এভিডেন্স ছিল না।

বিবিসি শুধু বলেছে ঐ নারী যে সময়ের কথা বলেছে এবং যে লোকেশানের কথা বলেছে সেই সময় এবং লোকেশানে ঐ নারীর উক্ত ক্যাম্পে থাকার প্রমান তারা পেয়েছে।

বিবিসির এই রিপোর্টের পরে, ইউএস স্টেট ডিপারমেন্ট বিবৃতি দিয়েছে, উই আর ডিপ্লি ডিস্টারবড।

চাইনিজরা দাবী করতে পারে, এই নারী পয়সা খেয়ে এই বিবৃতি দিয়েছে, বলতে পারে, সে তার জাতির সপক্ষে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্যে বাড়িয়ে বলেছে বা বলতে পারে সে এসাইলাম সিক করার জন্যে  এই বক্তব্য গুলো দিয়েছে। ফলে এই নারীর বক্তব্য নির্ভরযোগ্য না।

এথিকাল কমপ্লায়েন্স মেন্টেনের  জন্যে বিবিসির খুব শক্ত  অরগানাইজেশানাল স্ট্রাকচার আছে । ঠিক, একই কারণে বিবিসির নিজের কাছেই এই নারীর বক্তব্য নির্ভরযোগ্য মনে না হতে পারে।

কিন্তু কেন বিবিসি মনে করেছে, এই নারীর বক্তব্য নির্ভরযোগ্য যদি নাও হয় তবুও এই বক্তব্য গ্রহনযোগ্য।

এবং এইটা আমরা পাব্লিশ করতে পারি?

হোয়াটস দা ক্যাচ ?

গত দিন আমি আমার প্রফেসরের রেফারেন্সে আলাপ করেছিলাম বিষয়টা। তিনি  বলেছিলেন, কোয়ালিটিটেটিভ এনালিসিসে নির্ভরযোগ্যতা প্রধান বিষয় নয় ,  গ্রহনযোগ্যতা প্রধান বিষয়।

উনি বলেছিলেন, ভ্যালিডিটি  রিলায়বিলিটি থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

আমি রীতিমত আমার প্রফেসরকে চার্জ করে বসেছিলাম যে, এই টা ভুয়া কথা বলছেন।

এবং উনি জবাব দিয়েছিলেন  যে,

কয়ালিটেটিভ এনালিসিস  রিলায়েবল হইতে হবেনা তা আমি বলি নাই। , আমি বলছি, কোয়ালিটেটিভ রিসার্চের রেজাল্ট  সব সময়ে রিপ্রোডিউস করা যায় না, এইটা একেক টাইমে একেক রেজাল্ট দিতে পারে। ফলে কয়ালিটেটিভ রিসার্চে, রিসার্চটা যদি তার ষ্ট্যাণ্ডার্ডাইজেশান  এবং জাস্টিফিকেশানের দিকে সহি থাকে তবে এই রিসার্চের রেজাল্ট  গ্রহণযোগ্য। এইটা ভ্যালিড।

ইনভেস্টিগেটিভ জারনালিজম কোয়ালিটেটিভ রিসার্চ না।

কিন্তু, আলজাজিরার ডকুমেন্টারি নিয়ে খালেদ মহিউদ্দিনেরা  ডকুমেন্টারিটার  রিলায়েবিলিটি নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন সেই প্রসঙ্গে, আমার প্রফেসরের এই সিদ্ধান্তটা  খুব  গুরুত্বপূর্ণ।

উদাহরণ দেখেন, খালেদ মহিউদ্দিন তাসনিম খলিলকে সেনা প্রধানের একটি টেলিফোন কলের ডিটেলস নিয়ে চেপে ধরলেন। যে মহামান্য বলতে রাষ্ট্রপতি বোঝায় ইত্যাদি ইত্যাদি। নাউ ধরে নিলাম উনার যুক্তি ঠিক।

কিন্তু একটা জিনিষ খেয়াল করেন কিছু দিন আগে কনক সারোয়ার সেনা প্রধানের একটি টেলিফোন লিক করেছিল। সেখানে কিন্তু আরো বিস্ফোরক তথ্য রয়েছে।  ঐ লিকে প্রাপ্ত  সেনা প্রধানের বক্তব্য অনুসার র‍্যাবের কর্নেল জিয়ার বিরুদ্ধে  গুম খুনের  অভিযোগ সরাসরি  শেখ হাসিনাকে জানানোর পরেও তাকে সরানো হয় নাই, তার মানে সেনা প্রধান সরাসরি শেখ হাসিনাকে গুম খুন পরিচালনার অভিযোগ এনেছেন।

প্রগলভ রক্ত গরম কর্নেল সাহেবদের বক্তব্য বলে সেই আলোচনা হয়তো মেডিয়া এভয়েড করতে পেরেছে কিন্তু আমরা সবাই সেই বক্তব্য শুনেছি ।  আমি সিউর খালেদ মহিউদ্দিন ও শুনেছেন।

ফলে , এই ডকুমেন্টারিতে যে অভিযোগ গুলো এসেছে তা যে সঠিক  এবং মহামান্য না কি কি  ডাকছে সেই ত্রুটির রেফারেন্সে খালিদ মহিউদ্দিন সেনাপ্রধানের বক্তব্যের ইন্টারপ্রিটিশান ভুল বলার যে চেষ্টা করলেন সেইটা যে ভুয়া তা আমরা জানি।

আমাদের অভিজ্ঞতা এবং পূর্বের জানা এবং প্রেক্ষাপট সব কিছু মিলিয়ে  আমরা জানি ডকুমেন্টারিটা গ্রহনযোগ্য।

খালেদ মহিউদ্দিন বা আওয়ামী লিগাররা  বলার চেষ্টা করতেছে, সাইকোপ্যাথ চিহ্নিত হারিস আহমেদ নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি নয়। ফলে  তারা

দাবী করতে পারেন,  এয়ারপোর্টের ওসি বসাতেই তিন কোটি টাকা, টাকার ভাগ দিতে হয়, তার ভাগ  আইজি পায়- এই গুলো বলা যাবেনা কিন্তু, আমরা জানি এই গুলো সত্য।

ফলে ডকুমেন্টারির ক্লেইমটা  ভ্যালিড।  কারণ এই গুলো সবাই জানে।

কিন্তু খালেদ মহিউদ্দিন জানেন না। তিনি রিলায়েবিলিটির জায়গা গুলো ধরে টান দিলেন।

আমি খালিদ মহিউদ্দিনকে একজন  সাহসী জারনালিস্ট হিসেবে জানতাম।

আমি ভদ্রলোককে খুব গভীর ভাবে  ফলো করি নাই। কিন্তু এই বার করলাম।

এবং বুঝলাম যে,

বাংলাদেশের এই পতিত স্বৈরাচারকে রক্ষা  করতে উনার এবং ডয়েচে ভ্যালির  এক্টিভিজম -একটা জিনিষ প্রমান করে যে -এই মাফিয়া তন্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মিডিয়ার যে অভিযোগ তারা বিভিন্ন চাপের মুখে সব কথা বলতে পারেন না- সেইটা কি পরিমাণ অগ্রহনযোগ্য।

খালেদ মহিউদ্দিনের কোন রিস্ক নাই। উনি  জার্মানি থেকে  একটি শীর্ষ ইয়রপিয়ান জারনালিমের প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা। যেখানে উনার নিজের এই ধরনের রিপোর্ট করার কথা। 

কিন্তু দেখেন সেই কাজ না করে, উনি উনার সর্বস্ব নিয়োগ করেছেন প্রমান করতে এই ডকুমেন্ট রিলায়েবল না কিন্তু উনি যদি সাংবাদিকতার ভালো ছাত্র হইতেন তাহলে উনি জানতেন এই ডকুমেন্ট শত ভাগ গ্রহণযোগ্য কারন আমরা এতো দিন যা দেখেছি জেনেছি এবং আমাদের নিয়ত অভিজ্ঞতায় যে টর্চারের ভেতর দিয়ে যাই- এ ডকুমেন্টারি সেই সত্য গুলোই কনফারম করে। তাই কিছু আনরিলায়বিলিটি থাকলেও এইটা ভ্যালিড।

কিন্তু খালেদ মহিউদ্দিন এইটা জানেন না।

আমার মনে হয় এর চেয়ে প্যাথেটিক আর কিছু হইতে পারে না। বাংলাদেশের অবজেক্টিভ সাহসী জারনালিজমের  একজন পথ প্রদর্শক হিসেবে যাকে আমরা চিনি সে অন্তরে এই মাফিয়াতন্ত্রের আরেক জন কৈফিয়ত দাতা বাদে আর কিছুই নয়।

প্যাথেটিক।

যাক গে। বাই।

1 Comment

  1. চাপের জন্য কাজ করতে পারিনা কথাটা আর আগের মত নাই, এখন কেউ ইচ্ছা করেই গোপন তথ্য ফাস করেনা কারন এতে বখরা পাওয়ার মওকা থাকেনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.