অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)নাসিম মঞ্জুর একটি সেমিনারে বলেছেন , বাংলাদেশের করব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে ব্যবসাবৈরী। এ কারণে ব্যবসা বন্ধ করেই দেওয়া উচিত। আমরা যারা বাংলাদেশে ব্যবসা করি, আমরা কাল থেকে কান ধরে ছেড়ে দিতে চাই।’
এই বিষয়টা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যবসা সুচকে কত টুকু পিছিয়ে আছে , করোনা কালীন বিপর্যয় ইত্যাদি পর্যালোচনা হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয়, নাসিম মঞ্জুর ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার কারণ নিয়ে যে পর্যালোচনা হচ্ছে, সেখানে মুল প্রশ্নটা অনুল্লেখিত রয়ে যাচ্ছে।
তা হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব সিস্টেম এমন ভাবে সাজানো তাতে যে কর দেয়, তার উপরে এনবিআর তার সম্পূর্ণ ভার চাপিয়ে দেয়। অন্য দিকে, যে কর দেয় না তাকে কিছুই দিতে হয় না।
দেশিয় জুতোর ইন্ডাস্ট্রিতে তিন ধরনের কোম্পানি আছে।
১। কমপ্লায়েন্ট।
২। সেমি কমপ্লায়েন্ট।
৩। ফুল লি আন কমপ্লায়েন্ট।
জুতার ইন্ডাস্ট্রিতে ফুল কমপ্লায়েন্ট মূলত বাটা এবং এপেক্স। তারা কাঁচামালের উপরে শতভাগ ভ্যাট দেয়। এই কাঁচামালের উপরে ভ্যাট ১৫%। যেইটা বেশ চড়া মূল্য। যদিও এই ভ্যাট টা বেচার সময়ে কেটে নেওয়া যায়।
কিন্তু, নন কমপ্লায়েন্ট বা হালফ কমপ্লায়েন্ট কোম্পানি গুলো কেনা বেচা উভয় পর্যায়েই ভ্যাট দেয় না। হালফ কমপ্লায়েন্ট প্রতিষ্ঠান গুলো এনবিআরকে খুশি করতে কিছু পরিমাণ ভ্যাট দেয়।
নন কমপ্লায়েন্ট প্রতিষ্ঠান গুলো একেবারেই ভ্যাট দেয় না।
ওরিয়ন, প্রাণ-আরএফএল, ইউএস-বাংলা ও রানারের মত প্রতিষ্ঠান গুলোর হাতে কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, সেই গুলো সেমি কমপ্লায়েন্ট। অন্য দিকে, পুরাণ ঢাকার কোম্পানি গুলো, অথবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিষ্ঠান গুলো একেবারেই কম্পায়েন্ট না।
নাসিম মঞ্জুরের প্রব্লেম হচ্ছে, হালফ কমপ্লায়েন্ট কোম্পানি গুলোর সাথে তারা এখন টিকে থাকতে পারতেছেন না। কিন্তু এনবিআরের চাপ বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এনবিআর যেহেতু, নন কমপ্লায়েন্ট বা সেমি কমপ্লায়েন্ট কোম্পানির কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করতে পড়েনা, ফলে এনবিআরের পুরো চাপ পরে কমপ্লায়েন্ট কোম্পানি গুলোর উপরে।
আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, যদি বিক্রয়ের সময়ে কাচা মালের উপরে দেওয়া ভ্যাটের টাকা তুলে নেওয়া যায় তাহলে ভ্যাট দিতে সমস্যা কি ?
সমস্যা হচ্ছে, নন কম্পায়েন্ট বা সেমি কমপ্লায়েন্ট কোম্পানি গুলো যেহেতু বিক্রয়ের সময়েও ভ্যাট দেয়না অথবা যেইটা দেয় সেটাতে কারসাজী করে, ফলে, তার জন্যে কাঁচামাল বা বিক্রয়ে কোন পর্যায়ে ভ্যাট দিতে হচ্ছেনা, তাই সে উৎপাদিত পণ্যের দাম কম রাখতে পারে। কারণ, তার টাকা কেটে রাখার কোন প্রশ্ন নাই।
এই কারণেই বাংলাদেশে এপেক্স বা বাটার জুতার দাম বেশী পরে। কিন্তু, এপেক্স বা বাটা যেহেতু রিলেটিভ্লি লেস প্রাইস সেনসিটিভ একটা বাজারে অপারেট করে এবং যেহেতু তাদের নিজস্ব সাপ্লাই চেইন এবং রিটেইল চেইন আছে। তাই তারা ভ্যাট দিয়েও টিকে থাকতে পারে।কারণ তাদের কম্পিটিভ এডভানটেজ আছে।
কিন্তু এই কমপিতিতিভ এডভান্টেজ গুলো করোনা কালে হ্রাস পাচ্ছে। করোনা কালে মানুষ বেশী প্রাইস সেনসিটিভ। ।যে মানুষ আগে, ২০০০ টাকার জুতা কিন্তু সে এখন রাস্তার পাশের হকার থেকে ৭০০ টাকার জুতা কিন্তেছে।
কিন্তু এইটাও প্রধান সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে, এই যে এপেক্স বেশী ভ্যাট দেয়। এই কারণে, তারা এখন এনবিআরের টার্গেট।
বিগত তিন বছর ধরে এনবিআর পাগল হয়ে গ্যাছে। এনবিআর এখন এসে ফ্যাক্টরিতে হামলা করে। খাতা চেক করে দেখে, কাঁচামালের উপরে সম্পূর্ণ ভ্যাট দেওয়া হয়েছে কিনা। একই সাথে স্টক মিলায় দেখে, খাতার সাথে মিল আছে কিনা।এই গুলা আগে ছিল না। আগে টাকা পয়সা দিয়ে এই গুলো ম্যানেজ করা যেত। কিন্তু এখন এনবিআর তাদের কর্মচারিদের সামহাউ এমন ভাবে এম্পাওয়ার করেছে, এরা কোন ছাড় দেয় না। তুমি যত বড় হ্যাডাম ওয়ালা লোক হও, ভ্যাট দিয়ে হবে । কিন্তু। এনবিআরের ক্ষমতা নাই, হালফ কমপ্লায়েন্ট বা নন কমপ্লায়েন্ট কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করতে। সেই ম্যান পাওয়ার ই তাদের নাই। ফলে, তারা বড় কোম্পানি গুলোকে টার্গেট করে। যাদের এনবিআরকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই।
চোখের সামনে যে বড় কোম্পানি গুলো আছে। এই বড় কোম্পানি গুলোকে এখন এনবিআর প্রচণ্ড চাপে রেখেছে।
ইন্টেরেস্টিংলি, ২০১৯ এর পূর্বে বোর্ড অফ ইনভেস্টমেন্টের একটা আইনের সুবাদে এই বড় প্রতিষ্ঠান গুলো সুবিধা পেয়েছিল। এই আইন মতে, বোর্ড অফ ইনভেস্টমেন্টের রেজিস্ট্রেশান থাকলে, তারা আমদানিতে একটা কর সুবিধা পেত। এই সুবিধাটা এই বড় প্রতিষ্ঠান গুলোকে কাঁচামাল কেনার ক্ষেত্রে একটা এডভান্টেজ দেয়। যেই এডভান্টেজের কারণে, বাংলাদেশের অনেক গুলো ছোট এবং মিড সাইজ কোম্পানি হারিয়ে গ্যাছে।
এই সময়ে বড় প্রতিষ্ঠান গুলো কমপ্লেইন করে নাই। প্রতিদ্বন্দ্বী হারিয়ে যাওয়াতে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ হয়েছে।
কিন্তু ২০১৯ এর পরে সেই আইন আর নাই। এবং করোনার কারণে, মানুষের প্রাইস সেন্সিটিভিটি বেড়েছে। একই সাথে এপেক্স ও বাটার ওভারহ্যেড কস্ট বেড়েছে।
ফলে এখন এই প্রতিষ্ঠান গুলো আসলেই কম্পিটিশানের মুখে পড়েছে, কারণ তাদের খরচ বেড়ে গ্যাছে। নন কমপ্লায়েন্ট ছোট প্রতিষ্ঠান গুলো এখন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতেছে। একই সাথে এনবিআরের চাপ।
১৫% ভ্যাট অনেক উঁচু একটা পরিমাণ। একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সারা বছরে, ১৫% লাভ ও করতে পারেনা। ফলে, এনবিআর কাকে ভ্যাটের জন্যে চাপ দিচ্ছে কাকে দিচ্ছে না, কার ১৫% ভ্যাট দিতে হচ্ছে কার দিতে হচ্ছেনা। এই প্রশ্নটা আজকে টিকে থাকার এবং মুনাফার করার প্রধান প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এইটাই কমপ্লায়েন্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে নাসিম মঞ্জুরদের যন্ত্রণার মুল কারণ।
এই কারণে তিনি কান ধরে ব্যবসা ছেড়ে দিতে চান।
অর্থনীতি আমার কাছে বরাবরই দুর্বোধ্য। আপনার লেখাগুলো পড়ে এ বিষয়ে ধারণা পেতে চেষ্টা করি। এই লেখাটা পড়ে এনবিআরের দুর্বলতা এবং বৈষম্যমূলক আচরণ সম্বন্ধে জানতে পারলাম।
বুঝলাম না, যদি ১৫% ভ্যাটের জন্য ফুল কম্প্লায়েন্ড কোম্পানিকে চাপ দিতে পারে, তাহলে সেমি কম্প্লায়েন্ড কোম্পানিকে কেন চাপ দিতে পারবে না?!
কারণ এনবিআরের ক্যাপাসিটি নাই।
এপেক্স বা বাটার সাইজ বড়। বা কমপ্লায়েন্ট কোম্পানি গুলো অধিকাংশ বড়। ফলে এখানে অল্প চাপ দিলে বেশী , জুস বের করা যায়। কিন্তু সেমি কমপ্লায়েন্ট কোম্পানি গুলোকে চাপ দিলে, খুব বেশী বের হয় না। এন বিয়ারের জনবল এখন যে পরিমাণ তাতে, তাদের সামর্থ্য নাই সব কোম্পানিকে চাপ দেওয়ার। কিন্তু দুশ্চিন্তার কিছু নাই এনবিআর তার ক্যাপাসিটি দ্রুত বৃদ্ধি করছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সবাইকেই চিপে জ্যুস বের করা হবে।
Also some imported china goods has some effect right..
বিস্তারিত পড়লাম।
ভাই একটা অ্যাপের ব্যবস্থা করা যায় না? তাহলে বেশি সুবিধা হতো।
Valo laglo
হাফ কমপ্লায়ান্ট কোম্পানিগুলের সামনে এমন কি প্রণোদনা আছে যে তারা ফুল কমপ্লায়ান্ট হবে?
Is this pracrice good for trading business like importing cheap shoes from china ?
Good analysis. NBR, over the years has become increasingly powerful
আপনার লেখায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। আমাদের দেশে ভ্যাট ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমারও কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। ব্যবসায়ী নাসিম মুঞ্জর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা সেটা আমি ২০১৪ সালে ব্যাংকিং পেশা ছেড়ে দিয়ে রেস্টুরেন্ট করতে গিয়ে আমাদেরও পড়তে হয়েছিল।
ধন্যবাদান্তে
সাজিদ
কাঁচামালের ওপর ভ্যাট দিতে হয় ১৫%, ফিনিশড প্রোডাক্টেও কি এমন ভ্যাট?যদি না হয়, তবে বি.বাড়ীয়া/ভৈরব থেকে ফিনিশড প্রোডাক্ট বানিয়ে নিলে উত্তরণ হতে পারে হয়ত, তখন কান ধরা লাগবে না হয়ত… 🙂
ভ্যাট সেবাটি সংস্কার প্রয়োজন ।
ভ্যাট/ট্যাক্স ছাড়া একটা দেশ কিভাবে চলতে পারবে? সুতরাং, আপনি বলছেন যে কমপ্লায়েন্ট, সেমি কমপ্লায়েন্ট, ফুল লি আন কমপ্লায়েন্ট সবার উপর ভ্যাট আরপ করা এবং ভ্যাট ১৫% থেকে কমান একটা সমাধান?
হাফ কমপ্লায়েন্ট সুবিধা কিভাবে নিতে হয়।
হাফ কমপ্লায়েন্ট সুবিধা কেন বাটা এবং এপেক্স নিতে পারছে না?
এতে কি রাজনৈতিক শক্তি কাজ করে?
জানাবেন ভাইয়া।