২০০৯ সালের কোন একটা দিনে নতুন চাকরিতে যাবার পথে একটা সিগারেট কিনতে নামি। সিগারেট কেনার টাকা টা দিতে গিয়ে, সিগারেট বিক্রেতা কে দেখে হটাত আমার কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে আসে।
রাস্তার ধরে ছোট্ট একটা স্টল অপর পাড়ে শ্মশ্রুমণ্ডিত একটা প্রৌঢ় । প্রায় ১৫ বছর আগে, এই রাস্তায় আমি আর আমার বন্ধুরা এই প্রৌঢ়ের কাছে প্রথম সিগারেট কিনি। এবং এর পর দুই বছর এই মানুষটার সিগারেট স্টল এর আসে পাশেই আমাদের প্রতি দিন আড্ডা বসত। উনাকে আমরা চাচা ডাকতাম ডাকতাম। জীবনে প্রথম সিগারেট খাবার সময় সিগারেট কিনা থেকে সিগারেট খাবার পুরো প্রক্রিয়াটা ব্যাপক গোপনীয়তার সাথে করতে হত। এই প্রৌঢ় তখন ছিলেন মধ্য বয়সে। অনেক বার উনার কাছ থেকে বাকি নিছি, টাকা না থাকাতে।
আজ প্রায় ১৫ বছর পরে, সুটেড বুটেড হয়ে এই প্রৌঢ়ের কাছে সিগারেট নিতে দাড়িয়ে লজ্জায় আমার অস্তিত্ব যেন নাড়া খেল।
আমি বা আমার বন্ধুরা সবাই একটা কমফোর্টেবল মধবিত্ত আপব্রিংগিং থেকে আজ তারুণ্য পেরিয়ে মধ্যবয়সে ঢুকিঢুকি করছি। আমরা যারা এই খানে আড্ডা দিতাম, তারা সবাই চাকরি, ব্যবসা, সংসার সব কিছু সহ ভাল খারাপ মিলিয়ে স্বচ্ছন্দেই আছি।
কিন্তু, এই প্রৌঢ় এই ১৫ বছরে তার সিগারেট বিক্রি থেকে করা উপার্জনে তার অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারেন নাই।
তিনি একই রাস্তায়, ১৫ বছর ধরে ঠায় বসে আছেন।দিনে ম্যাক্সিমাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করেন, তার কোনো সোশ্যাল সিকিউরিটি নাই, কোনো সেভিংস নাই, ছেলে মেয়ে ভালো পড়াশোনা করানোর কোনো সুযোগ নাই।
এক সময় আমরা এই প্রৌঢ়ের থেকে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল ছিলাম। বাপ এর কোট এর পকেট থেকে, ৫০ টাকা মাইর দেয়া ছিল সর্বোচ্চ আয়।
কিন্তু, এই ১৫ বছরে আমি এগিয়ে গেছি, আমার বন্ধুরা সবাই এগিয়ে গেছে । কিন্তু, এই বৃদ্ধ সময়ের একটা মুহুর্তের মত ঠায় দাড়িয়ে আছেন।
আমার নতুন অফিসে যাবার স্যুট, কেতা দুরস্ত হাভ ভাব আমার নিজেকেই বিদ্রুপ করছিল। উনি ছল ছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন চাচা কেমন আছেন। আমি কিছু একটা উত্তর দিয়ে কোনো মতে সিগারেটটা নিয়ে, নিজের মধ্যে ঢুকে কিছু একটা বলে সরে আসলাম। কারণ এই মানুষটির সামনে দাড়িয়ে তার সাথে কথা বলার মত মানসিক শক্তি আমি পাচ্ছিলাম না। আসতে আসতে দেখলাম প্রায় ১৫ বছরের একটা ছেলে উনার পেছনে বসে, সিগারেট এর কার্টুন এর পেকেট খুলছে। নিশ্চয়ই তারপরের জেনারেশন। বাপ কে হেল্প করছে এবং পিতা অসুস্থ হলে একই পেশায় নেমে যাবে ।
বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে অনেকে গর্ব করেন। আমিও করি।
সারা পৃথিবী তে যখন ডিফ্লেশান চলছে তখনও বাংলাদেশ উন্নয়ন করেছে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ কন্সটেন্টলি ৫% থেকে ৬.৫% জিডিপি গ্রোথ এচিভ করেছে।
পোশাক শিল্প এগিয়েছে ব্যপক হারে, নতুন নতুন ব্যাংক হয়েছে, বিদেশ থেকে আসা আয় বেড়েছে, আমাদের রিজার্ভ বেড়েছে, আমাদের ডাক্তার ইউনুস সাব দরিদ্র বিমোচনের মডেল দেখিয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি নোবেল পেয়েছেন।
তাহলে এই প্রৌঢ় সিগারেত বিক্রেতা কেন ১৫ বছর ধরে, একই স্থানে আটকানো। উনার কেন কোনো ব্যাংক রিজার্ভ নাই, উনার কেন প্রতি বছর ৬% আয় এর গ্রোথ নাই, উনার কেন সোশ্যাল সিকিউরিটি নাই, কেন উনি ছেলেকে শিক্ষিত করে, ছেলের উপারজনে নিজের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারেন নাই।
আপনি বলতে পারেন, ধুর মিয়া কোন এক কৈশোর এর ফান্টাসীর সময়ের এক বুড়া নিয়া আপনি পেচাল পারতাসেন। এক বুড়া দিয়ে কি প্রমান হয় ?
আর কত লক্ষ লক্ষ লোক এর উন্নতি হইছে তা আপনি দেখেন না। আগে যত ফকির ছিল, এখন ফকির নাই।আগে কাজের লোক পাওয়া যেত ৪০০ টাকায়। এখন ১৫০০ টাকা দিয়েও কাজের লোক পাওয়া যায় না। আপনি পুরো একটা এন্টি আওয়ামী লিগার পাব্লিক।
আসলে এই প্রশ্ন গুলো সত্যি খুব ভালো প্রশ্ন।
আসলেই এক জন বুড়োর উন্নতি হয়নি বলে পুরো দেশের উন্নতি হয়নি? মধ্যবিত্তের আয় কি বাড়েনি। আমার পরিচিত জন কলিগ বন্ধু বান্ধব দের ফামিলির দিকে তাকাই তাহলেও তো দেখি আশির দশক থেকে বিংশ শতকের প্রথম দশকে অধিকাংশের উন্নতি কিছু হইলেও হইছে। কিন্তু আবার এও দেখি, আশির দশক থেকে নব্বই দশকে যে উন্নতি টা হইছে, বিংশ শতকের প্রথম দশকে এসে সেই উন্নতিটা চোখে পড়ে নাই।
আবার এও চোখে পরে, গ্রাম এর বা বিভিন্ন কাজ এ মফস্বল শহর গুলোতে যেই লোক গুলো কে, আগে চিনতাম তাদের অধিকাংশ কে বিগত ১৫/২০ বছরে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উঠতে দেখিনি।আমাদের পাড়ার একটা নিম্নবিত্ত ফামিলি নাই, যারা নিম্ন বিত্ত থেকে উচ্চবিত্তে হইছে। তাদের সবাইকে এই প্রৌঢ়ের মত ঠিক আগের অবস্থাই পাই। কোথায় সেই লক্ষ্ লক্ষ্ মানুষ যারা নিম্ন বিত্তের সীমা প্রেরিয়ে মধ বিত্তে পা দিছে। কেন, বাসায় বাসায় যারা বিগত ৪০ বছরে কাজের লোক হিসেবে কাজ করত, তারা সবাই কম বেশি ইদ এর সময় জাকাত নিতে আসে।
তাইলে কেন আবার গোল্ডম্যান সাক্স এর মত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে নেক্সট ১৫ ইমারজিং ইকনমি হিসেবে ধরতাছে। দুর্নীতি সত্ত্বেও এবং ইনফ্রাশ্ত্রাকচারের খারাপ অবসথা সত্ত্বেও জিডিপি কেমনে আগায়, সেইটাকে এখন নাকি বাংলাদেশ পারাডক্স বলে।
তাইলে আজকে যে উন্নতির কথা বলা হয়ে, তা আমরা চাক্ষুস দেখিনা কেন।
আমাদের চোখের সামনে আমরা দ্রুশ্যমান উন্নতি কেন দেখিনা। আই মিন আপনি শুধু ঢাকা শহরের বড় বড় কিছু বিল্ডিং বাদে, দেশের কথাও ইনফ্রাস্ট্রাকচারবড় রাস্তা দেখি না।
আর ঢাকা চিটাগাং ই বা এমন কি উন্নতি করছে।
১৫ বছরে ব্যাবধানে মাদ্রাজ শহরে যে উন্নতি হইছে,তার সাথে ঢাকার তুলনাই হয় না। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানি যেখানে সারা দেশের দেসের সব ক্যাপিটাল ঢুকে বসে আছেম, সেই ঢাকাই সুযোগ সবিধা ইনফ্রাস্ট্রাকচার, সব দিক থেকে বিশ্বের সব চেয়ে পেছনে থাকা কস্মোপলিটান সিটি গুলোর মধ্যে পরে।
তাইলে, উন্নয়ন টা হইলো কোন জায়গায় ?
ইন্ডিয়াতে গুরগাও বলে যে শহর টা গড়ে উঠছে একদম শূন্য থেকে, বাংলাদেশে তেমন একটা নতুন শহর কেন গড়ে উঠে নাই কেন। ঢাকা বাদে দেশের আর কোথাও বড় ইনফ্রাস্ট্রাকচার নাই কেন । মালেশিয়াতে যে বিশাল বিশাল রাস্তা দেখলাম, এই ধরনের একটা রাস্তা বাংলাদেশে নাই কেন। কেন, মফস্বল এর রাস্তা গুলো ঠিক আগের মত, ২০ বছরে কিছু শপিন কমপ্লেক্স এবং প্রাইভেট বিল্ডিং বাদে কিছু হয়নি। তাহলে তো দেখা যাচ্ছে, ঢাকা চিটাগাং বাদে উন্নয়ন একদমই দৃশ্যমান না।
কেন গ্রামে গেলে, যেই মানুষ গুলোকে ৩০ বছর আগে দেখেছি, খেতে খামারে কাজ ডেইলি মজুর হিসেবে কাজ করতে তাদের এখনও গিয়ে একই অবস্থায় পাই। তাইলে উন্নয়ন টা কার হইলো ? এবং ৬% জিডিপি দিয়া ইন্ডিয়া, পাকিদের লগে তরকে জিততে পারলাম কিন্ত, আমার নিজের ধান্দাই তো কাটেনা।
তাইলে কি আমাদের ডেভেলপমেন্ট এর ইনডেক্স গুলো কোন ভুল সিগনাল দিচ্ছে নাকি আমরা কিছু মিস করতাছি নাকি মন এর কোনো সীমাবদ্ধতার কারণে এই উন্নতি গুলো আমি বা আমার মত অনেকে দেখতেই পারতাছিনা।
এই প্রশ্ন গুলো সহ আমাদের ডেভেলপমেন্ট এর নানা ইসু নিয়া, আগামী কিছু দিন আমি পেচাল করব।
আমি নিজে ইকনমিকস এর ফরমাল স্টুডেন্ট না। অর্থনৈতিক বিষয়ে আগ্রহ আছে , ডেভেলপমেন্ট পলিটিক্স এ আগ্রহ আছে। সেই জন্যে অল্প যা কিছু জানি বা পড়ি বা নিজের যা অবজারভেশান আছে তা শেয়ার করব, আমি রিকোয়েস্ট করি আপনাদেরকেও আপনাদের আইডিয়া শেয়ার করতে।
আমার ফ্রেন্ড লিস্ট এ বেশ কয় এক জন ইকনমিস্ট আছে। মহসিন ভাই, রিয়াজ ভাই যাদের মধ্যে দুই জন। এবং খুব ভালো এক্সপেরিয়েন্সে আছে ডেভেলপমেন্ট ইসুতে এমন অনেক ডেভেলপমেন্ট একটিভিস্ট আছেন।যেমন শেখ মোহাম্মদ দিন ভাই, পিনাকি দা, মুন্তাকিম ভাই। জাস্ট কয় একজন এর নাম নিলাম। কিন্তু, আরো অনেকই আছেন যারা এই বিষয়ে জানেন বা প্রাতিষ্ঠানিক পড়া শোনা করেছেন। আমি রিকোয়েস্ট করব আপনাদের ইন্পুট দিতে।
এই লেখাটার নাম আমি দিছি শহুরে মধ্যবিত্তের উন্নয়ন ভাবনা। কারণ, এইটা আসলেই তাই।
আমি এবং আমার মত শহুরে মধ্যবিত্তের পুরো দেশ কে বোঝার এবং এপ্রিসিয়েট করার মধ্যে একটা ডিস্কানেক্ট আছে।
আমরা কত সহজে কাজ এর লোক পাওয়া, এবং রাস্তায় কেন আগের মত ফকির দেখিনা এই মাপকাঠিতে দেশের উন্নয়ন কে জাজ করি। নিজেরা আরামে থাকলে নিরব দারিদ্র কে উপলব্ধি করিনা। আবার অনেক সময় দেশ ভালো চললেও হটাত সিজনাল মুল্যব্রিদ্ধি সময় সরকার এর পিন্ডি চটকাই। শুধু মাত্র ট্রেন বা বা বাসে , যাবার সময় আমরা বাংলাদেশ কে দেখি- সেই দেখায় অনেক ভুল এবং মিসিন্ফর্মেশান থাকে। আমি এর মধ্যে কিছুটা লাকি কারণ, বিভিন্ন কারণে, দেশের আনাচে কানাচে ঘোরা হইছে এবং কিনলি যেই খানে যাই সেই খানের ইনটেরেসটিং কিছু দেখলে মেন্টাল নোট রাখি।
এই সিরিজটাতে এই ধরনের কিছু আলোচনা থাকবে ।
কৃষি, শিক্ষা ,চিকিত্সা ,ব্যবসা, অর্থনীতির বৈশিস্ট্য, রিটেল, সরকার, রাস্তা ঘাট, সরকারী প্রতিষ্ঠান বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যাঙ্ক, বামপন্থী আর কাপিটালিজম এর দন্দ, ক্যাপিটালিজম এর সমস্যা, সমাজতন্ত্রের সমস্যা , ট্রিকল ডাউন ইকনমিক্স এর সমস্যা, গার্মেন্টস, এবং কম্পারাটিভ্লি বাংলাদেশের সাথে অনান্য দেশ গুলো কোথায় আগাইছে এবং আমরা কোথায় আগায়ছি, মুভি ইন্ডাস্ট্রি, কালচার, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি- ইত্যাদি ইত্যাদি আমরা কাভার করব।
এইটা মূলত পার্সেপ্টরী আলাপ, যাতে অল্প কিছু নেট রিসার্চ এবং ব্যক্তি অভিজ্ঞতা থাকবে, কিন্তু আমি আশা করব এক্সপার্টরা তাদের ইনপুট দিবেন কমেন্টস এ। আমি সেইগুলো পরে সামারি করে, আবার নোট এ এড করব। বা সেপারেট নোট করব।
এই পুরো আলোচনাতে একটা গোল আছে। এইটা শুধু মধ্যবিত্তের উন্নয়ন রোমান্টিকতা নয় বরং রিয়েলি উন্নয়ন এর বাধা গুলো এবং রিয়েল স্টেপ গুলো কি তাও আমরা টাচ করার চেষ্টা করব।
আমি প্রথম যেইটা টাচ করব আগামী কিস্তিতে, তা হলো ইন্ডিকেটর।
আমরা দেখব আসলে আমাদের দেশের ডেভেলপমেন্ট এর পুরো গল্পটাই ফাকি। কারণ, আমাদের ইন্ডিকেটর গুলো মূলত পলিটিকাল টুলস। সরকারি সিস্টেমে এমন মেকানিযম নাই, যাতে এই ইনডিকেটর গুলো মাপা যায়। এবং আমরা এমন কিছু ইন্ডিকেটর নিয়ে আলাপ করব, যা ফাকি দেয়া যায় না। যেমন শিল্প খাতে ব্যান্ক ঋণ এর প্রবৃদ্ধি , পোর্ট এর গুডস এর কন্টেইনার উঠা নামার হিসাব এবং আরো কিছু।
বাংলাদেশের ভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটার বিষয় এ কারো কাছে যদি কোনো ভালো লেখা, বা লিংক থাকে প্লিজ সেয়ার কইরেন
আশা করি পার্টিসিপেট করবেন আর সাথে থাকবেন।