দিন-কয়েক আগে একজন ছোট ভাইয়ের সাথে হঠাৎ পথে দেখা। আমি জানি যে ভাইটা একটা কারনে খুবই সিরিয়াস ঝামেলার মধ্যে আছে। তাকে দেখলাম প্রচণ্ড খুশী। এবং আমাকে দেখে তার মুখ চোখ ঝলমল করে উঠলো “ভাইয়া একটা খুশির খবর আছে।” তার মুখের এতো খুশী দেখে ভাবলাম বোধ হয় তার লাইফের সিরিয়াস ঝামেলাটা কেটে গ্যাছে। আমি বললাম বলেন বলেন কি খুশির খবর।
বললো, মিন্নির ফাঁসি হইছে।
শুনে পুরো দ হয়ে গেলাম। তার ঝলমলে মুখ দেখে ভাবছিলাম, ভাইটা তার ইমিগ্রিশান সংক্রান্ত বিশাল একটা ঝামেলা থেকে মুক্তি পাইছে। কিন্তু, সে জাস্ট খুশী, মিন্নির ফাঁসি হইছে। তার মুখ আনন্দে ঝলমল করতেছে। বিষয়টা ভাবালো।
একজন বন্ধু আমাকে একটা লিঙ্ক পাঠালো , তাতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট নিউজের একটা ভিডিওতে মিন্নির আইনজীবী সাক্ষাতকারে বলছেন, মিন্নি খোলা আদালতে জানিয়েছে, তার সাক্ষ্য জোর করে নেওয়া হয়েছে। এবং মূলত, কিছু মাদক মাফিয়াকে বাঁচানোর জন্যে মিন্নিকে ফাঁসানো হয়েছে। মিন্নি সম্পূর্ণ নির্দোষ।
সেইটা বিষয় না। একজন আইনজীবী তার মক্কেলকে সেভ করার জন্যে অনেক কিছু বলবেন। কিন্তু, ইউটিউবের সেই ভিডিওর কমেন্টে দেখলাম হাজার হাজার সতি সাবিত্রী ভাইয়ের কমেন্ট, “এই মাগীর ফাঁসিটা তাড়াতাড়ি দেওয়া হউক””আইনজীবীকে ফাঁসি দেয়া হোক। ওর দোন। অণ্ডকোষ চেপে মারা হোক।” “দন আই খান পান্না তুমি আমার বালের উকিল হয়েছ, গাজাখুরি আলাপ করে উকিলের সার্টিফিকেট কিভাবে পেল? পুরু গেইম তৈরি করেছে গুটি-বাজ মিন্নি””কিয়ো দাদা আপনার ছেলে যদি এমন করে কুপিয়ে হত্যা করত তাহলে কি করতেন?? আমার মনে হয় দাদাকে ডিম দেয়া দরকার “”শালার বেটা একটা বেশ্যা খুনিকে বাঁচানোর কত চেষ্টা।”আমি এই গুলো নিজে লিখি নাই, জাস্ট কপি পেস্ট করলাম।
বিষয়টা ভাবালো। কিভাবে মিন্নিই যে এই পুরো হত্যার জন্যে দায়ী -তার জন সম্মতি তৈরি করলো , রাষ্ট্র-পক্ষ ?কিভাবে শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষের মধ্যে মিন্নির প্রতি এই ঘৃণা উৎপাদন করা গ্যাছে, যার ফলে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে বিপন্ন একজন ব্যক্তি ভাবতে পারতেছে, মিন্নির ফাঁসির আদেশ তার জন্যে একটা খুশির দিন। এমনকি মিন্নির আইনজীবীর ডিফেন্সের পরে কমেন্ট আসতেছে, “মিন্নির, আইনজীবীকে ও ফাঁসি দেওয়া হলে অনেক খুশি হবো, শালা। ” “তোদের মত উকিলে জন্য মানুষ অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে”। “বুরা-খাটাস। তোরে দিয়া চাটাইছে মিন্নি তুই মিন্নির সাফাই গাতাছচ”।
আমি আইনজীবী না এবং আমি এই সেনশনাল হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ইন টোটাল ফলো করি নাই। এবং গত তিন মাস ধরে আমি সোশাল মিডিয়া থেকে শতভাগ দূরে থাকার চেষ্টা করি । ফলে এই বিষয়ে আমার কোন এক্সপার্ট অপিনিয়ন দেওয়ার সুযোগ নাই। কিন্তু, শুরু থেকেই হালকা ভাবে যে কয়টা জিনিষ দেখেছি, তাতে কিছু জিনিষ দেখেছি, যা মিলে না। ১। রিফাতকে যখন হত্যা করা হয়েছে সেই ভিডিও দেখেছি। তাতে আমি দেখেছি, মিন্নি আরনেস্টলি রিফাতকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। এবং যত দূর মনে পরে, ভিডিওটাতে মিন্নি এমন সব পজিশনে রিফাতকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল যে, তার গায়েও কোপ পড়তে পারতো। এইটা অভিনয় করা অসম্ভব বলে আমি মনে করি। এবং মিন্নি যদি হত্যার প্ল্যানার হতো সে সেই খানে থাকতো না। মিন্নি জানতো না, সেই খানে ভিডিও হচ্ছে। কারন ভিডিও টা দূর থেকে তোলা। ২। মিন্নি হত্যার পরে,অনেক গুলো পত্রিকার রিপোর্টে এসেছে। রিফাত এবং নয়ন বন্ড উভয়েই স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক সুনাম দেবনাথের পৃষ্ঠপোষকতা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। (বিডি নিউজের লিঙ্ক কমেন্টে)। ফলে এইটা তখনি পরিষ্কার হয় এইটা জাস্ট, ত্রিভুজ প্রেম বা দাম্পত্য বা রেষারেষি নিয়ে ঘটনা নয় এর পেছনে, এলাকার শীর্ষ গডফাদার স্থানীয় সংসদের মাদক ব্যবসার একটা যোগ সূত্র আছে। এবং এই রিপোর্ট গুলোতে আরো জানা যায়, স্থানীয় মাদক গডফাদারদের প্রশ্রয়ে নয়ন বন্ড’র মতো আরও কিছু তরুণ ও কিশোর বাহিনী যেমন ‘টিম ৬১’, ‘লারেলাপ্পা’, ‘হানী-বন্ড’ আরো কিছু গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে যাদের আধিপত্য নিয়ে অনেক খুন জখম হত্যার ঘটনা আছে।
বিডি নিউজের এই রিপোর্টে আমরা আরো দেখি বলা হচ্ছে, “রিফাত শরীফ তার সহযোগীদের নিয়ে রিফাত ফরাজীকে হাতুড়ি পেটা করেন। যাতে ক্ষিপ্ত ছিলেন দুই ফরাজী ভাই।”আমার মনে আছে, এই সময়ে আওয়ামী লীগ এবং স্থানীয় সংসদ একটা চাপের মুখে পরে। কারন এই ঘটনায় স্থানীয় সংসদের নেতৃত্বে বরগুনায় মাদক ব্যবসার বিষয়টা উন্মোচিত হতে থাকে। ৩। শম্ভু সাহেবের পরিবারের মাদক গডফাদার পরিচয়ের বিষয়টি সোশাল মিডিয়াতে সারা দেশে আলোচিত হওয়ার এই সময়েই ঘটনা ধীরে ধীরে পালটে যেতে থাকে। এবং এরপরে আমি আর ডিটেল জানিনা। খুব সম্ভবত অনেক স্ক্রিন শট, ঘটনা সহ নিউজ পেপারে রগরগে স্টোরি হতে থাকে। এবং ধীরে ধীরে শম্ভু সাহেবের ছেলে মাদক গডফাদাররা পুরো আড়ালে চলে যায় এবং মিন্নিকে বানানো হয়, এই ঘটনার মূল মাস্টার মাইন্ড। নয়ন বন্ডকে ক্রস ফায়ার করা হয়। ৪। এবং মিন্নির জবানবন্দি প্রচারিত হয় যে, সে নিজের মুখে শিকার করেছে, সে এর ওর সাথে শুইছে। এবং সে নিজেই প্ল্যান করেছে, রিফাতকে হত্যা করার। মিন্নির জবানবন্দি পরে মনে হচ্ছে মিন্নি পুরা ফাঁসিতে ঝুলার জন্যেই এই জবানবন্দি দিয়েছে। আই মিন,সে যদি সত্যিকারের অপরাধী হয়ও তাও, সে অপ্রকৃতস্থ না হলে, এই ধরনের জবানবন্দি দিবেনা। পুরা একটা বলিউড ফিল্মের স্ক্রিপ্টের মত সেই জবানবন্দি। আমি এর সাথে শুইছি, ওর সাথে শুইছি এর ওর সাথে প্ল্যান করছি। পুরা মনে হইছে, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু প্লাস কান্নাড়ি সফট পর্ণ ফিল্মের স্ক্রিপরাইটারের এক সাথে বসে লেখা।
মিন্নির আইনজিবি, ইন্ডিপেন্ডেটের সাক্ষাতকারে বলেছে যে মিন্নি ওপেন কোর্টে বলেছে এই জবানবন্দি জোর করে নেওয়া হয়েছে, তাই এই জবানবন্দি আমলে নিয়ে তাকে শাস্তি দেওয়া যাবেনা। কিন্তু সেই জবানবন্দীর ভিত্তিতে ফাসি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই জবান বন্দি সবাই মিন্নির বক্তব্য হিসেবে শেয়ার করছে, পত্রিকার রিপোর্ট হচ্ছে। কিন্তু কেউ বলছেনা, মিন্নি ওপেন কোর্টে বলেছে এই জবান বন্দি সাজানো। তাকে জোর করে এইটা সাইন করানো হয়েছে। আমি যেহেতু এই ঘটনা নিয়ে খুব ডিটেল জানিনা। তাই , আমি মিন্নি দায়ী কি দায়ী কি না তা নিয়ে জাজমেন্টে যাবোনা। এইটা নিশ্চিত সময়টা এমন ভাবে ক্ষয়ে গ্যাছে, রাষ্ট্র নিজেই এখন মাদক ব্যবসা করে, পুলিশ নিজেই এখন মাদকের সব চেয়ে বড় ডিলার, সাংসদ নিজেই কিশোর গ্রুপ তৈরি করে আধিপত্য বিস্তার করে খুন করায়, এবং যেখানে সব চেয়ে প্রধান আসামীকে ক্রস ফায়ার দেওয়া হয় তখন শীর্ষের এই পতনের ধারাবাহিকতায়, সমাজের সকল পর্যায়ে যে পচন হয় তার থেকে মিন্নি, আমি আপনি কেউ মুক্ত নই। কিন্তু, আমি আওয়ামী লিগের আমলে সাধারণত ভিক্টিমকে সিম্প্যাথাইজ করি।
আমার একটা জাজমেন্ট হচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে মাফিয়ারা এমন ভাবে দখল করেছে। এখানে অপরাধীর শাস্তি হয় না, ভিক্টিমের শাস্তি হয়।এবং আমি যা দেখেছি বুঝেছি তাতে, আমার মিন্নিকে অপরাধী মনে হয় না, ভিক্টিম মনে হয়। আমি তাই মিন্নির প্রতি সিম্প্যাথাইজ করি। এইটা সারকামস্টেন্সিয়াল এভিডেন্ট গুলোর ভিত্তিতে আমার অনুভূতি। এইটা ক্লিয়ার কেন নয়ন বন্ডকে মারা হয়েছে । দেখেন, মিন্নিকে ফাঁসানর পর থেকে, কিন্তু সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক সুনাম দেবনাথের কোন আলাপ আর মাঠে নাই। সবাই মিন্নিকে নিয়ে মেতে আছে। মিন্নি রূপসী। ফলে তাকে নিয়ে বাঙ্গালি অবদমন সব ভাবেই বের হয়ে আসে। কিন্তু, এইটা নিশ্চিত যে শক্তি নয়ন বন্ডকে ক্রস ফায়ার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেই শক্তিই, মিন্নিকে ফাঁসি দিয়েছে। ফলে সহজেই তাকে সামনে রেখে রাঘব বোয়ালদের আড়াল করা গ্যাছে যে ঘটনা গুলো বের হয়ে আসা শুরু করেছিল। কিন্তু সেইটাও বিষয় না। এই গুলো বাংলাদেশে ডাইল ভাত হয়ে গ্যাছে। আমি বরং আরো কিন, আর একটা প্রবণতা বুঝাতে, মাফিয়ারা এখন শুধু মাত্র ক্ষমতা নয় মিডিয়াও চালায়। এবং মাফিয়ারা এখন মিডিয়া দিয়ে, একজন ভিক্টিমকে সামাজিক ভাবে হেয় করতে করতে এমন জায়গায় নিতে পারে, যখন তাকে অপরাধী মনে হয়। যখন সমাজ জন সম্মতি তৈরি হয়, “এই মাগীর ফাঁসিটা তাড়াতাড়ি দেওয়া হউক”এই প্রবণতাটা গত কয়েক বছরে খুব স্পট দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে খুব সহজেই রাষ্ট্র কোর্ট পুলিশ সেন্সেশ্নাল মামলা গুলো বিচার করে ফেলতেছে। রাষ্ট্র নির্ধারণ করতেছে, কোন লোকটা আসামী হলে- আওয়ামী লিগের ক্ষমতা কাঠামো অক্ষুণ্ণ থাকবে। মাফিয়া তন্ত্রের গডফাদারদের কেউ দোষ দিতে পারবেনা। সেই লোক গুলো সব দায় শিকার করে জবানবন্দি দিচ্ছে। সেই জবান বন্দীর অনুসারে কোর্ট রায় দিয়ে দিচ্ছে। এমন কি, ওয়ার অন টেররের অনন্ত যুদ্ধেও, রাষ্ট্র যাকে গ্রেপ্তার করে। সে সব কিছু জবানবন্দি দিয়ে স্বীকৃতি দিয়ে দেয় সে আইসিস ছিল খুন করেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর তাকে হয় ফাঁসি নয়, ক্রস ফায়ার দিয়ে হাপিশ করে দেওয়া হয়।
রিফাত হত্যার ঘটনায় – সে অপরাধী হোক কি না হোক- একটা মিথ্যা জবানবন্দি দিয়ে যেভাবে তাকে ফাঁসানো হয়েছে এবং যেভাবে বিভিন্ন স্টোরি লিক এবং নিউজ রিপোর্ট দিয়ে তার ফাঁসির জন সম্মতি তৈরি করা হয়েছে তাতে বোঝা যায় আজকে শুধু সাংসদ এবং পুলিশ এবং মিডিয়া মিলে এমন একটা মাফিয়া সাম্রাজ্য কায়েম করা হয়েছে। যে মাফিয়ারা শুধু মাত্র ক্ষমতা ব্যবহার করে, একজন ভিক্টিমকে ফাঁসিতেই ঝলায় না, তার আগে মিডিয়া দিয়ে রিপোর্ট করিয়ে সেই ফাঁসির জন সম্মতিও তৈরি করিয়ে নেয়