গত দুই বছরে ধরে সিরিয়ায় যে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছে তার এক পক্ষে আছে, সিরিয়ার বিগত ৪০ বছরের ধরে শাসনকারী আলাওয়াইটস গোত্রের নেতৃত্বে বাথ পার্টি এবং তাদের সমমনারা , অন্য দিকে আছে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা, যাদের মধ্যে রয়েছে সিরিয়ার ৬০% জনগোষ্ঠীর সুন্নি জনগোষ্ঠী এবং তাদের সম মনারা|
এই দুই পক্ষের লড়াই এ গত দুই বছরে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ মারা গেছে এবং ৪০ লক্ষ মানুষ বাস্তুহারা হয়ে আশ্রয় নিয়েছে রিফিউজি ক্যাম্পে|
গত ২১ অগাস্টে , কেমিক্যাল এটাক হয়ে প্রায় ১০০ জন বেসামরিক ব্যক্তির নিহত হওয়ার ঘটনার পর থেকে সিরিয়াতে একটা সম্মিলিত সামরিক আক্রমণ আসন্ন বলে অনেকে সন্দেহ করছেন|
সিরিয়ান সরকার এই আক্রমণ অস্বীকার করেছে এবং রাশিয়া স্পষ্ট ভাবে বলেছে এই আক্রমণ বিদ্রোহীদের দ্বারা করা এবং একটা সামরিক আক্রমণ জাস্টিফাই করার জন্যে, এই ঘটনাটা সাজানো হয়েছে|অন্য দিকে প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছে, তিনি নিশ্চিত এই আক্রমণ সিরিয়ান সরকার এর করা|
রুপার্ট মারডক আর জীয়নিস্ট ব্লক নিয়ন্ত্রিত ইঙ্গ মার্কিন মিডিয়া গোষ্ঠী রণ দামামা বাজিয়ে চলছে প্রতিদিন| অন্য দিকে চীন এবং রাশিয়া স্পষ্ট ভাবেই সকল ধরনের সামরিক আক্রমণ এর বিরুদ্ধে| তাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ একটা স্নায়ু যুদ্ধ পরবর্তী নতুন বিশ্বের মেরুকরণের একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে| সিরিয়াতে বাস্তবে কি হচ্ছে তা বলা প্রায় অসম্ভব| কারণ, যে সব আন্তর্জাতিক গণ মাধ্যম হতে আমরা সংবাদ পাই, তাকে এনালাইজ করে কে কেন কি করছে তা বোঝা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে| কারণ, বিবিসি, সিএনএন বা রয়টার্স বা এ এফপি এদের সবার নিজস্ব একটা প্যান ওয়েস্টার্ন এজেন্ডা আছে| ফলে শুধু মাত্র তাদের ভাষ্য গিলে সিরিয়ার সত্যিকার এর ঘটনা ফিল্টার করা খুব মুশকিল|
তাহলে সিরিয়াতে হিরো কে, কে বঞ্চিত, কে অপরাধী, কে সাফারার ? সিরিয়াতে এখন কি হচ্ছে ? সামনে কি হবে ?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে সিরিয়ার নিকট ইতিহাস , বর্তমান দ্বন্দ্বের ক্ষেত্র এবং সিরিয়ার জাতিগত অন্তর্দন্দের প্রেক্ষাপট গুলো নিয়ে এই গরু রচনা| এই আলোচনা গুলো আমাদের বুঝতে হেল্প করবে, সিরিয়াতে কার মোটিভ কি? এবং মুল ইস্যু গুলো কোথায়? এবং কেন সিরিয়ার দ্বন্দ্বের এত দিনে কোনও সমাধান হচ্ছেনা| এবং কেন বর্তমানে সিরিয়াতে যে সামরিক আক্রমণ এর কথা হচ্ছে, তার আসল মোজেজা টা কি|
আমরা তাই একটু দেখি সিরিয়ার পক্ষ বিপক্ষ গুলো কি| এই পক্ষ বিপক্ষের অবস্থান এবং মোটিভেশন গুলো জেনে নিলেই আমরা বুঝতে পারব সিরিযায় কি হচ্ছে |
তার আগে আমরা একটু দেখি ঘটনার শুরু কোথায় |
২০১০ এর ডিসেম্বর সালে যখন আরব বসন্তের আগমনে সারা আরব জাহান টালমাটাল, সিরিয়া তখন মোটামুটি শান্ত| অনেকে এনালিস্ট মনে করেছিলেন, সিরিযাতে তেমন গেনজাম হবেনা কারণ, কারণ সিরিয়ার শাসন ব্যবস্থায় গত ৪০ বছর ধরে শক্ত কন্ট্রোল বজায় রেখেছে বাসার আল আল আসাদ এর নেতৃত্বে বাথ পার্টি|খুব সামান্য একটা ঘটনা থেকে সিরিয়াতে প্রটেস্ট শুরু হয়| ২০১১ সালের মার্চের মাঝামাঝি সময় ১০/১২ জন ছেলে দেয়ালে সরকার বিরোধী চিকা মারার ঘটনার পর সরকারী বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করে টর্চার করে| তার প্রতিবাদে যে বিক্ষোভ হয় সেই বিক্ষোভে সরকারী বাহিনী ব্যাপক ভাবে গুলিবর্ষণ করে এবং তাতে অনেক বিক্ষোভকারীরা মারা যায় এবং সেই বিক্ষোভ দেশ ব্যাপী ছড়িয়ে পরে| এবং প্রতি টা ক্ষেত্রেই বাসার আল আসাদ এর সরকারী বাহিনী ব্যাপক এগ্রেসিভ ভূমিকা নেয় ফলে বিক্ষোভ আরও ছড়িয়ে পরে এবং এপ্রিল মাসে আসাদ সারা দেশের শহর গুলোতে আর্মি এবং তার অনুগত সিক্রেট সার্ভিসকে মাঠে নামায়| যারা ট্যাঙ্ক , আর্টিলারি এবং হেলিকপ্টার গান-শিপ সহকারে দেশ ব্যাপী অপারেশন চালায়|
মাত্র তিন মাসে ২০১১ সালের জুলাই নাগাদ প্রায় ১৬০০০ বিক্ষোভ-কারি নিহত হয় আসাদ বাহিনীর হাতে| এরপর ঘটনা প্রবাহ এত জটিল যে তার ট্রাক রাখা মুশকিল| বিরোধীদের মধ্যে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের মধ্যে রয়েছে প্রায় ১২০ গ্রুপ এবং উপগ্রুপ| তাদের নিজেদের মধ্যে অনেক দ্বন্দ্ব থাকলেও আপাতত বিদ্রোহীরা একত্রিত হয়ে একটি অর্গানাইজড ফোর্স ঘটন করেছে যার নাম দেয়া হয়েছে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি| ফ্রি সিরিয়ান আর্মিতে সিরিয়ান সরকার এর অনেক সৈন্য পক্ষ ত্যাগ করে জয়েন করেছ|প্রথমে শুধু হালকা অস্ত্র এবং মর্টার বা এই ধরনের অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করলেও, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ , ফ্রি সিরিয়ান আর্মি তুরস্ক থেকে প্রত্যক্ষ সাপোর্ট পায় এবং ২০১১ সালের অক্টোবরে সরকারী সেনাদের উপর ট্যাঙ্ক এবং হেলিকপ্টার সহযোগে প্রথম হামলা চালায় এবং কোম শহর দখল করার জন্যে |
এরপর থেকে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি দেশের অনেক টুকু অংশ দখল করে|
সিরিয়ার ৭০% এলাকা বর্তমানে বিরোধীদের দখলে, যার বেশির ভাগ অংশ হচ্ছে গ্রামীণ এলাকা এবং কিছু সুন্নি প্রধান শহর এবং ৩০% এলাকা রয়েছে আসাদ এর অনুগত বাহিনীদের দখলে যার মধ্যে রয়েছে সিরিয়ার সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর ডামাস্কাস এবং আলেপ্পো এবং স্ট্রাটেজিকালী গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই রুট এবং বন্দর গুলো|
অনেকেই বিস্মিত হন যে এত শক্ত প্রটেস্ট,এত রক্ত ক্ষয় এত ধংসের পরেও বাসার আল আসাদ কেন ক্ষমতা ছাড়েনা| কেন এত প্রাণ হানির পরেও কোনো ধরনের ছাড় দিতে প্রস্তুত না| সারা দেশে এত বড় অপ্রায়জিং এবং দেশের এক লক্ষ মানুষ মরে যাওয়ার পরে একটা সরকার এর একটা মরাল দায়িত্ব থাকে, ক্ষমতা ছেড়ে একটা নতুন প্রসেস শুরু করার| সব চেয়ে ভয়ঙ্কর স্বৈরশাসক ও এক সময় নত হয়| ইতিহাস তাই বলে| কিন্তু, বাসার আল আসাদ সামান্যতম নত হচ্ছে না| যে কোনও কিছুর বিনিময়ে সে ক্ষমতা ধরে রাখছে|
এর থেকে বোঝা যে সিরিয়ার জনগণ এর একটা অংশের মধ্যে বাসার আল আসাদ এর সমর্থন আছে| এবং শুধু বাসার আল আসাদ নয় জনগণের এই অংশের কাছে, ক্ষমতা ছাড়ার স্টেক টা অনেক হাই| এত হাই যে, যে কোনও পরিমাণ রক্ত ঝরার পরেও তারা ক্ষমতা ছাড়তে প্রস্তুত নয়|
আমরা টাই একটু দেখি, সিরিয়ার জনগণ এর মধ্যে এই গ্রুপ গুলো কারা এবং কাদের স্বার্থ কোথায়| সিরিয়ার ডেমো গ্রাফিক্স এর মধ্যে ৬০% সুন্নি আরব , ১২% আইলোয়াটস আরব, নন আরব কুর্দি ৯%, ১৩% ক্রিস্টিয়ান তার মধ্যে ৯% অর্থোডক্স এবং ৪% আর্মেনিয়ান, ড্রুজ আরব ৪% এবং ইসমায়লি ২%|
সিরিয়ার মূল দ্বন্দ্ব টা, এই রেস ডিভিশন এর মধ্যেই|
বাসার আল আসাদ এবং সিরিয়ার রুলিং পার্টির মূল নেতৃত্ব এসেছে আলাওয়াটস গোত্র থেকে যারা ৬০% সুন্নির উপর শাসন এস্টাবলিশ করেছে| আলাবিরা প্রায় ১০০০ বছর ধরে ছিল, সিরিয়ার অচ্ছুৎ একটা গ্রুপ| যাদের এলাকার তৈরি শস্য সুন্নি মুসলমানেরা এক সময় গ্রহণ করতো না| সেই আলাবিদের মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে ক্ষমতা সঞ্চয় করে ৬০% সংখ্যা গরিষ্ঠ সুন্নি মুসলমানদের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করা অনেক বিশ্লেষক এর কাছে সৌদি আরবের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজন ইহুদি ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মত একটা বিস্ময়কর ঘটনা|
কিন্তু হইছে,ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহে, এইটা হইছে| অনেকে বলেন| এইটা একটা সুনির্দিষ্ট প্লান এর মাধ্যমে হইছে, অনেকে বলে এইটা এক্সিডেন্টালই হইছে| কিন্তু বাস্তবতা হল, এইটা একই সাথে এক্সিডেন্ট এবং একটা প্লান এর মাধ্যমে হইছে, যার সুযোগ করে দিছে সিরিয়ান আর্মি যেই প্রতিষ্ঠানে ফরাসী উপনিবেশ এর আমল থেকে আলাউই দের সংখ্যা গরিষ্ঠতা এস্টাবলিশ ছিল |
আলাওয়াইটস কারা
আলাওই গোত্রকে ফরাসী শাসকদের ডাকা উচ্চারিত অপভ্রংশ থেকে আলাওয়াইটস নামটা এসেছে| | ইতিপূর্বে তাদের নুসায়রী বলেই বেশি ডাকা হতো| এই নাম পরিবর্তন এর একটা সিগনিফিকেন্স আছে| নুসায়রী শব্দটা থেকে আলাউই শব্দটা বেশি গ্রহণযোগ্য কারণ আলাওয়াইটস শব্দটার মানে হজরত আলীর অনুসারী| বর্তমানে আসাদ এর বিরোধীরা, গালি দিতে গিয়ে আলাউই দেরকে নুসায়রী বলে ডাকে|
শিয়া ধর্মে ১২ জন ইমাম এর একটা ধারা আছে যাদেরকে টুয়েল্ভার বা বারোদের অনুসারী বলা হয়| আলাবী দের ধর্ম গুরু ইবনে নুসায়ের শিয়াদের ১২ জন ইমাম এর একজন|
খেয়াল রাখতে হবে যে জাতিগত দিক থেকে আলাউইরা আরব বংশ ভুত|
তাদের আলাবী পরিচয় টা এসেছে তাদের ধর্ম থেকে| আলাবী দের ধর্মীয় নীতি কঠোর গোপনীয়তার রক্ষা করা হয়| আলাউই ধর্মের অনেক অনুশাসন এসেছে আরব অগ্নি উপাসক, জরাসথু এবং পাগান ধর্মের কাছ থেকে| আলাউইদের মদ পানে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই| তাদের হিজাব পালনের কোনও নীতি নাই| তারা ক্রিশ্চিয়ানদের অনেক অনুষ্ঠান যেমন ইস্টার, ক্রিসমাস ইত্যাদি পালন করে| আলাউই দের কোন মসজিদ নেই| তারা তাদের ধর্ম গুরু দের বাসায় সমবেত হয়| ইবনে বতুতা তার ভ্রমণ কাহিনীতে লিখেন যে, আলাউই দের কোন মসজিদ না থাকার কারণে, খলিফা প্রতিটা গ্রাম এ মসজিদ করে দিয়েছে কিন্তু সেই মসজিদ এ গরু চরে|
ইতিপূর্বে অনেক ক্রিশ্চিয়ান মিশনারীর বক্তব্যের রেফারেন্স আছে যারা বলে গেছেন, আলাবীরা সুন্নি মুসলমান দের ধারা থেকে যত দুরে, ক্রিশ্চিয়ানিটি থেকে তত বেশি কাছে|এবং আলাবী ধর্ম শিয়া অনুশাসন এবং ক্রিচিয়ান অনুশাসন এবং পাগান অনুশাসন এর একটা মিক্স|
আলাবী দের ধর্ম গোপনীয় হওয়ার কারণে তাদের যৌন আচরণ এবং পারিবারিক অনুশাসন সম্পর্কে আরও অনেক অনেক গুজব প্রচলিত| ১৬ বছর বয়সে একজন আলাউই তার ধর্ম শিক্ষা পায় এবং আলাবী মহিলারা ধর্ম শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনা| তারা গাছ পাতা এবং বন এর উপাসনা করে| এমনকি সকল আলাউই তার ধর্মের সকল শাসন জানতে পারেনা|
আলাবী দের কিছু অদ্ভুত প্রাকটিসে এবং অনুশাসনের কারণে তারা মুসলমান কিনা এই নিয়ে ইসলামিক নেতার ফতোয়ার রেফারেন্স আছে ১২০০ শতক থেকেই|
এবং ইবনে খতিব ১২০০ সালে আলাবী দের কে কাফের ঘোষণা করে| পরবর্তীতে অনেক প্রমিনেন্ট সুন্নি ধর্মীয় নেতা আলাবী দেরকে ধর্ম বর্জনকারী বা মুরতাদ হিসেবে ঘোষণা দেয়| এমনকি শুধু সুন্নি নেতারা নয়, শিয়া নেতারাও আলাবী দের কাফের হিসেবে দেখত|আহমেদ ইবনে তেরিয়া, সিরিয়ার একজন মধ্য যুগের বিখ্যাত ধর্ম গুরু (১২৬৮-১৩২৮) আলাবী দেরকে সম্পূর্ণ ভাবে বর্জন করতে বলেছিলেন, তাদের ধর্মীয় আচরণ কের কারণে|অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ পর্যায়ে আলাবীদের কে আবার সুন্নিতে কনভার্ট করার চেষ্টা করা হয়| আলাওয়াইটস দের কে শিয়া মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আয়াতুল্লাহ খো মেনি এবং ইরাক এর ধর্মীয় নেতা মুসা আল সদর| আরব নাশনালিযম এর স্বার্থে সৌদি গ্রান্ড মুফতি এলবি দের কে সাম্প্রতিক কালে মুসলমান হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, ঐতিহাসিক ভাবে আলাবী দের কে মুসলমান হিসেবে বিবেচনা করা হয় নাই|
আলাবীদের ইতিহাস বলে তারা ছিল পশ্চাৎপদ এবং ভবঘুরে জনপদ|
অটোমান সাম্রাজ্যের পুরো সময় তাতে আলাবীরা সুন্নি শাসক দের তারা অত্যাচার এর শিকার হয়| তাদের এমনকি কোর্ট গিয়ে বিচার চাওয়ার অধিকার ছিলনা| সুন্নিরা তাদের অচ্ছুত মনে করত এবং তাদের কোনও ধরনের সম্পদ ছিলনা, শিক্ষা ছিলনা| ফলে তারা সম্পূর্ণ ভাবে একটা সুনির্দিষ্ট এলাকায় বাস করত এবং দেশের অন্য জনগোষ্ঠীর সাথে মিশত না| এমন কি আলাবী দের এলাকার তৈরি শস্য সুন্নি রা গ্রহণ করত না| অল্প কিছু আলাবী আছে, যারা অটোমান সাম্রাজ্যের সময় সরকারী পজিশন গুলোতে আরোহণ করতে সক্ষম হয়|
সিরিয়ার মাপ দেখলে দেখবেন, ৮০ আলাউইরা লাটাকিয়া অঞ্চলের পাহাড়ে বাস করে| বর্তমানে সিরিয়াতে ১৩ লক্ষ আলাউই আছে যাদের মধ্যে ৭৫% বাস করে, লাটাকিয়া প্রভিন্সে| এবং এই প্রভিন্স এ তারা ৮০% জনগোষ্ঠী|
পরবর্তীতে আলাউইরা যখন ক্ষমতায় আসে বাথ পার্টির হাত ধরে তখন দামেস্কে আলাবী জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পায়|এই আলাউইরা কিভাবে আজ সুন্নি মেজরিটির উপর শাসন প্রতিষ্ঠা করলো, তা বোঝার জন্যে আমরা সিরিয়ার ইতিহাসের চলে যাই| যেই খানে সিরিয়ার সুন্নি, ক্রিশ্চিয়ান , আলাউই সবার ইসু আসবে|
আমরা এখন আলাউইদের ইতিহাস থেকে একটু চলে যাই সামগ্রিক সিরিয়ার ইতিহাসে |
বর্তমানে যেই দেশটাকে আমরা সিরিয়া বলি তার জন্মের সময় এবং পরবর্তী ভাঙ্গা গড়ার রাজনৈতিক ইতিহাসটা সিরিয়ান কনফ্লিক্ট এর সব গুলো পক্ষ কে বোঝার জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ|সিরিয়া কোন জাতি রাষ্ট্র না| সিরিযাতে সিরিয়ান বলে কোন জাত নাই| বর্তমানে সিরিয়ার যে ভৌগলিক সীমানা তা একটা বিভিন্ন পরিবর্তন এর আলোকে একটা অপরিকল্পিত সীমানা|১৫১৬ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত সিরিয়া ছিল অটোমান খিলাফত এর আন্ডারে| সেই সময় শুধু সিরিয়া না বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের সব গুলো দেশই অটোমান সাম্রাজ্যের আন্ডার এ ছিল| সেই সময় আলেপ্পো আর ডামাস্কাস ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের দুইটি প্রধান প্রদেশ এর রাজধানী| এই দিকে ত্রিপলি ছিল আরেকটা | এবং সেই সময় গ্রেটার সিরিয়া বলতে যেই জায়গা বোঝাত তাতে আজকের লেবানন, ইসরায়েল, জর্ডান, গাজা সহ টার্কির বেশ কিছু অংশ পরে|
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান সাম্রাজ্যের সব আরব দেশ গুলোকে একটা চুক্তির মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নেয় ফ্রান্স আর ইংল্যান্ড| চুক্তির প্রণেতাদের নাম অনুসারে এইটাকে বলে সাইক্স পিকট এগ্রিমেন্ট| এই এগ্রিমেন্ট এর পরিকল্পনা অনুসারে বর্তমান জর্ডান, দক্ষিণ ইরাক এবং হাই ফা এলাকা থাকে ব্রিটেন এর মেন্ডেট অনুসারে আর উত্তর ইরাক, সিরিয়া, লেবানন এবং তুরস্ক থাকবে ফ্রান্স মেন্ডেট অনুসারে | এই চুক্তিতে তৎকালীন রাশিয়ান জার রাও, একটা পক্ষ ছিল| তাদের দখলে থাকার কথা ছিল, বর্তমান তুরস্কের একটা অংশ যেইটাই ইস্তাম্বুল এবং আর্মেনিয়া|তাদের পরিকল্পনা ছিল, লোকাল নেতাদের দিয়ে তারা এই অঞ্চল গুলো পরিচালনা করবে, কিন্তু শাসন ক্ষমতা তাদের হাতে থাকবে| কিন্তু ব্রিটেন এবং ফ্রান্স এর এ প্লানটা গোপন ছিল|
এর অংশ হিসেবে ১৯১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দামেস্কে সুন্নি আরবরা মক্কার শরিফ এর খাদেম আমির ফায়সাল ইবনে হুসাইনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে নিয়ে অটোমান সম্রাট দের হাত থেকে দামেস্ক দখল করে|
১৯১৯ সালে আমের ফায়সাল ভার্সাই ট্রিটির সময় আরব শাসনে একটি বৃহৎ আরব সাম্রাজ্যের পরিকল্পনা দেয়, যেইটা সফল হয় নাই| একই বছর এই গ্রেটার সিরিয়াতে একটা ইলেকশন হয় যার থেকে সিরিয়ান ন্যাশনাল এসেম্বলি জন্ম নেয়| ১৯২০ সালে, ন্যাশনাল এসেম্বলি আমের ফায়সাল কে, তুরু পাহাড় থেকে সিনাই মরুভূমি পর্যন্ত এলাকায় সিরিয়ার রাজা হিসেবে ঘোষণা করে|১৯২০ সালে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড আরব ভূমিকে নিজেদের মত ভাগ করে নেয় এবং যাতে গ্রেটার সিরিয়া থাকে ফ্রান্স এর এলাকায় এবং প্যালেস্টাইন থাকে ব্রিটিশ এলাকায়|এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ফ্রেঞ্চ সৈন্যরা, ১৯২০ সালে দামেস্ক আক্রমণ করে, আমের ফায়সাল এবং তার অনুগতদেরকে পরাজিত করে এবং আমির ফয়সাল সিরিয়া থেকে পালিয়ে যায়|দখল করার পর, ফ্রেঞ্চরা লেবানন কে সিরিয়া থেকে আলাদা করে এবং সিরিয়া কে তিনটি স্বায়ত্তশাসিত এলাকায় ভাগে ভাগে করে, যেই খানে ছিল সিরিয়া ছিল আলাওয়ীদের জন্যে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র, দ্রুজ দের জন্যে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র|
ভারতীয় উপমহাদেশের মতই, আরব জাহানে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টা ছিল, স্বাধিকার এর লড়াই এর সময়|
সিরিয়াতে এর নেতৃত্ব দিয়েছে সুলতান আল আতরাশ যিনি ছিলেন একজন দ্রুজ আরব | তার নেতৃত্বে সিরিয়ার স্বাধিকার এর আন্দোলন দামেস্ক থেকে লেবানন এ চড়িয়ে পরে| ১৯২৫ সালে, ফ্রেঞ্চ ট্রুপস রা আরব ন্যাশনালিস্টদের দমন করতে ডামাস্কাস এর বম্ব নিক্ষেপ করে এবং সুলতান আল আতরাশ কে মৃত্যুদণ্ড দেয়, যদিও সুলতান আল আতরাশ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন|
১৯২৮ সালে সাধিকার আন্দোলনকারীদের চাপে ইলেকশন হয় এবং প্রভিন্স এর প্রধান হন হাশেম আল অতসী| তার নেতৃত্বে পরবর্তীতে একটা সংবিধান ড্রাফট করা হয়| ১৯৩৬ সালে ফ্রেঞ্চ রা, সিরিয়াকে স্বাধিকার দেয়ার জন্যে চুক্তি করে কিন্তু সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করে নাই| ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জেনারেল গল যুদ্ধ শেষে সিরিয়ার স্বাধীনতা দিতে সম্মত হয়| যুদ্ধের সময় জার্মানি সিরিয়া দখল করে যা পরে আবার মিত্র বাহিনী দখল করে এবং যুদ্ধ শেষে জাতীয়তাবাদীদের চাপে ১৯৪৬ ফ্রেঞ্চ ট্রুপ্সস রা সিরিয়া ত্যাগ করে| এবং এপ্রিল ১৭
১৯৪৬ হচ্ছে সিরিয়ার স্বাধীনতা দিবস|
স্বাধীনতার পূর্বের সময়ে আলাউইদের অবস্থান
১৯১৮ সালে প্রথম মহাযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যের পতন এর পর, সিরিয়া যখন ফ্রেঞ্চ মেন্ডেট এ পরিচালিত হয়| তখন ইতিহাস প্রথম বার এর মত আলাউইরা কিছু টা ক্ষমতা অর্জন করে| এর প্রধান কারণ, ফ্রান্স যে নেটিভ আর্মি গড়ে তলে তাতে তারা আলাউইদের প্রাধান্য দেয়|
আলাবীরা অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর, শতাব্দীর যে বঞ্চনা তার থেকে মুক্তি পেয়ে ফ্রেঞ্চ দের পক্ষে থাকে| তারা সুন্নি
জাতীয়তাবাদী নেতা প্রিন্স ফায়সাল এর ঘোর বিরোধিতা করে|এবং ফ্রেঞ্চরাও অন্যদিকে আলাবীদের প্রমোট করে| ফলে ফ্রেঞ্চ এবং আলাবী দের এই ঘনিষ্ঠতার কারণে পরবর্তিতে ফ্রেঞ্চ রা আলাউইদের জন্যে লাটাকিয়া টে একটা প্রভিন্স করে ১৯২২ সালে এবং তাকে স্বায়ত্তশাসন দেয়| এর ফলে আলাবীরা প্রথম বার এর মত রাজনৈতিক স্বাধীনতা পায়| এবং আলাবী জজদের হাতে প্রথম বার আলাবী কোর্ট হয়|
পুরো সিরিয়া যখন ফরাসীদের কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার লড়াই করছে, এবং ফ্রেঞ্চ বাহিনীর আলাবী সেনাদের ব্যাটালিয়ন গুলো ফ্রান্সকে বিদ্রোহ দমন সহায়তা করে ১৯৩৬ সালে যখন আলাউই স্টেট লাটাকিয়া কে আবার সিরিয়ার সাথে সংযুক্ত করা হয়, তখন কিছু প্রমিনেন্ট আলাবী নেতা ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট কে চিঠি দিয়ে বলেন,
আলাবী রা রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক দিক থেকে সুন্নি দের থেকে আলাদা| এবং তারা আলাবীদের জন্যে আলাদা দেশ দাবি করে| এই প্রমিনেন্ট নেতাদের মধ্যে একজন ছিলেন, হাফেজ আল আসাদ| বর্তমান বাসার আল আসাদ এর দাদা|
কিন্তু তাদের সেই দাবি পূর্ণ হয় নাই| লাটাকিয়া স্টেট সিরিয়ার সাথে যুক্ত হয়| কিন্তু ততদিনে আলাউই রা শতাব্দী ধরে চলা দুর্বল অবস্থান কাটিয়ে সিরিয়ান সেনাবাহিনী শক্ত অবস্থান গড়ে নিয়েছে|
এখন আমরা আসি স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসে|
১৯৪৬ সালে স্বাধীনতার পর পরেই সিরিয়াতে সিভিলিয়ান সরকার প্রতিষ্ঠা হয়| এবং সরকার গঠন করে আরব জাতীয়তাবাদী সুন্নি নেতারা যারা সিরিয়ার স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছেন|১৯৪৬ সালে আলাবী রা, সিরিয়া থেকে আলাদা হওয়ার জন্যে কিছু বিদ্রোহ করে, কিন্তু সেই গুলো সফল হয়নি এবং বিদ্রোহের নেতাদের কঠোর ভাবে দমন করা হয়|
১৯৪৯ সালে সিরিয়ার প্রথম মিলিটারি কু টা হয় যাতে ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর হাতে কেন্দ্রিভুত হয়|
একি বছর তিন নাম্বার পাল্টা ক্যু টে, ফাইনালি ক্ষমতা সংহত হয় কর্নেল সুন্নি আরব আদিব সিস্কিলির হাতে| এই লোক শাসন করেন, চার বছর ১৯৫৩ পর্যন্ত|
সিস্কিলি সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে এবং তার সমর্থক পেপার বাদে বাকি পেপার গুলোকে বন্ধ করে দেয়|এই চার বছরের শাসনটা, আমার কাছে মনে হইছে সিরিয়ার ইতিহাসের একটা ডিফাইনিং টাইম| কারণ, সেই সময় সিস্কিলির হাতে মাইনরিটির উপর বিভিন্ন রকম অত্যাচার হয় এবং আরব দ্রুজরা এই সময় বিদ্রোহ করে এবং খুব নৃশংস ভাবে সেই বিদ্রোহ দমন করা হয়|
১৯৪৭ সালে সিরিয়ান আরব সোশিয়ালিস্ট বাথ পার্টির জন্ম হয় যার প্রধান প্রবক্তা ছিলেন আলাবী গোত্রের জাকি আল আরসুজি এবং ক্রিস্টিয়ান শিক্ষক মিশেল এফ্লেক| বাথ পার্টি শুরু থেকেই সেকুলার মাইন্ডের ছিল| বাথ পার্টির ছায়া তলে থাকে প্রগ্রেসিভ সুন্নি এবং সিরিয়ার বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা|
১৯৫৪ সালে আর একটা ক্যু কর্নেল সিস্কিলির কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে নেয় আর্মি| এই ক্যুতে বাথ পার্টি সহায়তা করে, যার ফলে এই ক্যুতে বাথ পার্টির ক্ষমতা সংহত হয়| আর্মি ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয় সিভিলিয়ান শাসনকর্তাদের কাছে| সরকার প্রধান হন সক্রি আল কোইতি|
কৈতির সরকার এর হাতে, আরব জাতীয়তাবাদীদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়| এবং সেই সময় সুয়েজ যুদ্ধে মিশরের হাতে ইসরায়েল এর পরাজয় এর পর কারণে পুরো আরব বিশ্বে নাসের এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়| এবং এই ধারায় আরব জাতীয়তাবাদ এর উত্থান ঘটে|
১৯৫৮ সালে সক্রি আল কোইতি এবং মিসের প্রেসিডেন্ট গামাল নাসের মিশর এবং সিরিয়াকে একীভূত করে|
কিন্তু, একীভূত হবার পর, গামাল নাসের সিরিয়ার সব পলিটিকাল পার্টি কে ব্যান করে| এবং মিশরের আচরণে অসন্তুষ্ট সিরিয়ানরা ১৯৬১ সালে আবার আলাদা হয়ে আসে মিলিটারি ক্যু এর মাধ্যম্যে|
১৯৬৩ সালে বাথ পার্টির নেতা এবং মিলিটারি অফিসাররা এক হয়ে ন্যাশনাল কমান্ড কাউন্সিল ঘটন করে| এবং বাথ পার্টির নিয়ন্ত্রণে একটা সুইডও মিলিটারি ক্ষমতা সিরিয়ার নেতৃত্বে আসে| ১৯৬৩ বছর টা সিরিয়ার ইতিহাসে ক্রিটি কাল| কারণ এই সময় আর্মি থেকে আরব সুন্নি অফিসার দের বহিষ্কার করা হয়| এবং আলাবীরা আর্মির ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে| ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭০ সাল আলাউই আর্মি অফিসার দের মধ্যে কু পাল্টা কুর শেষে ১৯৭০ কর্নেল হাফেজ আল আসাদ ক্ষমতায় আসে, যিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ এর পিতা|হাফেজ আল আসাদ ক্ষমতায় থাকেন ২০০০ সাল পর্যন্ত|
হাফেজ আসাদ একটা অচ্ছুত মাইনরিটির প্রতিনিধি হয়ে কি ভাবে এত দিন টিকে থাকলেন ?
তার প্রধান কারণ হচ্ছে মিলিটারি এবং দ্বিতীয় কারণ বাথ পার্টি |
সিরিয়ার স্বাধীনতা পূর্ব এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে মিলিটারিতে আলাউইরা মেজরিটিতে পরিণত হয়| এবং ১৯৬৩ সালে অধিকাংশ সুন্নি অফিসার দেরকে বহিষ্কার করার পর মিলিটারিতে ৮০% সদস্য|
মিলিটারি সাথে আর একটা কারণ হইলো বাথ পার্টি| বাথ পার্টি শুরু থেকেই ছিল সেকুলার একটি দল| সুন্নি আরব এবং ইসলামপন্থীদের বিপক্ষে একটি শক্ত প্লাটফরম হিসেবে সিরিয়াতে বাথ পার্টি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে|এবং তার কারণে, মিলিটারিতে থাকা মাইনরিটি অফিসার রাও বাথ পার্টির সাথে সংযুক্ত হয়| এবং বাথ পার্টির সিভিলিয়ান অংশ এবং আর্মির মিলিটারি অংশ মাইল মিশে দেশকে শাসন করে| তাছাড়া সমাজতান্ত্রিক ধারণা, সম্পদের সুষম বণ্টন সহ আরো অনেক আইডিয়া বাথ পার্টিকে অনেক সুন্নি আরব এর কাছেও গ্রহণযোগ্য করে তোলে| তাছাড়া বাথ পার্টির আইডিয়লোজি টে আরব জাতীয়তাবাদ খুব গুরুত্বপূর্ণ| সিরিয়া এবং মিশরের একত্রীকরণের সময় বাথ পার্টি খুব গুরুত্তপুর্ন ভুমিকা রাখছিল, যদিও পরবর্তীতে তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়|
আমরা একটু দেখি বাথ পার্টির ইডিওলজি কি ?
সাদ্দাম হোসেন এর ইরাকে এবং হাফেজ আল আসাদ এর সিরিয়াতে বর্তমানে শাসন করছে যে বাথ পার্টি তাদের ইডিয়লোজিকে বলা হয় বাথিযম| এই ইডিয়লজির জনক আলাবী জাকি আল আরসুজি এবং ক্রিস্টিয়ান শিক্ষক মিশেল এফ্লেক| দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার সময় পুরো আরব অঞ্চলে কলোনিয়াল শাসন থেকে মুক্তির যে সংগ্রাম চলছিল সেই সংগ্রাম এ আরব জাতীয়তা এবং সমাজতন্ত্রের মিশ্রণ ঘটিয়ে বাথিযম এর আইডিয়ার জন্ম নেয় |
বাথিযম এর অনেক গুলো আইডিয়া এসেছে মার্কস এর কাছ থেকে, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক মুভমেন্ট হলেও সারা বিশ্বের সোভিয়েত ব্লক বা চাইনিজ ব্লক এর সোশালিস্ট মুভমেন্ট এর সাথে বাথ মুভমেন্ট এর কোন সম্পর্ক ছিলনা| কিন্তু হাফেজ আল আসাদ তার সম্পূর্ণ শাসন আমলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মেইনটেইন করেছেন|বাথ পার্টির জন্মের ইতিহাসে দেখা যায়, আরব ন্যাশনালিস্ট বোধ এর সাথে সাথে সম্পদের সুষম বন্টনের চেষ্টা করে একটা প্রগ্রেসিভ রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামিক ক্লার্জিদের শক্ত অনুশাসন মুক্ত একটা রাষ্ট্র গড়ার ধারনাটাই অরিজিনাল বাথ পার্টির দর্শন|
আরব জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সেকুলার শাসন ব্যবস্থা, বাথিযম এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলেও বাথিজম আরব ন্যাসনালিজ্ম এর একটা অংশ হিসেবে ইসলামিক অনুশাসন এবং ইসলাম ধর্মকে এই মুভমেন্ট এর একটা প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়|
বাথিযম এর প্রধান প্রবক্তা মিশেল এফ্লেক তার লেখায় আরব থেকে ইসলাম এর জন্ম এবং বিশ্বব্যাপী আরবদের হাত ধরে ইসলাম এর আত্মিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক বিজয় অর্জন করাকে আরব জাতীয়তাবাদ এর আধিপত্য হিসেবে দেখিয়েছেন| আবার একই সাথে তিনি গোত্র এবং রাজাদের প্রাধান্য খর্ব করে, রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা থেকে ইসলামকে বিযুক্ত করে দেশে দেশে বা পুরো আরব জাহানে একটা সিঙ্গুলার দল এর শাসনে সম্পদের সম বন্টন করে একটা প্রগ্রেসিভ রাষ্ট্র গড়ার ধারণা দেন|
এই ধারণা থেকে তারা, সিরিয়ার সাথে মিশর এর একত্রীকরণের পক্ষে থাকেন|
মিশেল এফ্লেক এর লেখা দেখা যায়, তিনি মনে করেন গোষ্ঠী তন্ত্র, রাজতন্ত্র, আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য একটি সার্বজনীন আরব পুনর্জাগরণ এর পথে বাধা| এবং পুনর্জাগরণ এর জন্যে বাথ পার্টি, মার্ক্সিজম এর মত একটা একক ভ্যান-গার্ড পার্টির মাধ্যমে সংগ্রাম এর ধারণা কে প্রমোট করে|
এবং এই ধারণা থেকে সিরিয়াতে হাফেজ আল আসাদ সোভিয়েত ইউনিয়ন স্টাইলে একক পার্টি এস্টাবলিশ করে এবং সিক্রেট পুলিশ দিয়ে সমস্ত বিরুদ্ধ মোট কে দমন করে|
বাথ শব্দের মানে হচ্ছে, রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ|
এক দিকে আরব জাতীয়তাবাদ, আরেক দিকে সমাজতন্ত্র, এক দিকে সেকুলারিজম আর অন্য দিকে আরব জাতীয়তাবাদ এর অংশ হিসেবে ইসলামকে প্রাধান্যকে দেয়া – এই ধরনের অনেক বৈপরীত্য নিয়ে বাথিজম শুধু মাত্র ইরাক এবং সিরিয়াতে ক্ষমতা দখল করতে পারলেও, গোঁড়া ইসলামিস্ট আর শেখদের পরিচালিত রাজতন্ত্রের বিপক্ষে একটা শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে দাড়ায়|একই সাথে একক দলের শাসন এবং বিরুদ্ধ মত এর প্রতি অসহনশীলতা ও ব্যক্তিপূজা সিরিয়া এবং ইরাক উভয় দেশেই বাথ পার্টিকে একটা নিপীড়ক এবং অত্যাচারী শক্তিতে পরিণত করে এবং কোনও ধরনের জবাবদিহিতার অভাবে উভয় দেশেই বাথিস্টরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন করে ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে উঠে|
বাথ পার্টি সম্পর্কে এই টুকু জেনে রাখা প্রয়োজন কারণ, আমরা পরে দেখব, সিরিয়ান গৃহযুদ্ধে শুধু ইন্টারনাল পলিটিক্স এর একটা অংশ নয়| সিরিয়ান এবং ইরাকি বাথ সরকার আরব বিশ্বের পলিটিক্সে একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ| এবং সৌদি আরব কাতার সহ আরো রাজতন্ত্রী দেশ গুলো কি কারণে, বাসার আল আসাদ এর পতন দেখতে চায় তাদের নিজেদের স্বার্থের কারণে এবং কি কারণে তারা বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়ে সাপোর্ট দিচ্ছে|
এখন আমরা জানলাম,বাসার আল আসাদ এর পিতা হাফেজ আল আসাদ কেমনে ক্ষমতায় আসলো এবং কেমনে আলাউই গোত্রের ক্ষমতা সংহত করলো,
কিন্তু কট্টর আরব জাতীয়তাবাদীরা কি তা মেনে নিছে ? ইসলামপন্থী রা কি সেকুলার শাসন কি মেনে নিছে ? মেজরিটির উপর মাইনরিটির শাসন কি সুন্নি আরবরা মেনে নিছে ?
আলাবী গোত্র নিয়ন্ত্রিত বাথ পার্টির শাসনের কয় একটা বৈশিষ্ট্য হলও, আলাবীরা কোনও মতেই তাদের ধর্ম কারো উপর এস্টাবলিশ করতে যায় নাই| ধর্ম পালনে সুন্নি আরব রাও কোনও বাধা পায় নাই বা ধর্মের কারণে কেও নিষ্পেষিত হয় নাই|
কিন্তু সুন্নি মুসলমানদের কে রাজনৈতিক ভাবে সংগঠিত হওয়ার কোনো সুযোগ দেয়া হয় নাই | ১৯৬৩ সালেই বাথ পার্টি ক্ষমতা দখল করার পর মুসলিম ব্রাদারহুডকে ব্যান করা হয় |
একই সাথে সুন্নিদের তাদের প্রতি বিরাগ তাকে কমানোর জন্যে, তাদের ধর্মের কিছু নিয়ম নীতি এড-জাস্ট করে, ইসলাম এর মূল ধারায় আসার চেষ্টা করেছে| বাসার আল আসাদ বিয়ে করেছেন, একজন সুন্নি মুসলমান কে| কিছু দিন আগে, বাসার তার ছেলের কোরান পরার একটা ভিডিও পাবলিশ করে|
সুন্নি আরবরা, আসাদ পরিবার এর শাসন কখনই মেনে নেয় নাই এবং এবং আলাবিদের বিরুদ্ধে বিভিন্য সময় তারা বিক্ষোভ করছে ||
পরবর্তীতে সব ধরনের সুন্নি প্রতিবাদকে সিরিয়ার সিক্রেট পুলিশ শক্ত ভাবে দমন করে| ১৯৭৫ সালে সিরিয়ার সুন্নিরা বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবাদ আর বিদ্রোহ শুরু করে এবং মুসলিম ব্রাদারহুড এবং কিছু বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহীরা |
দেশ ব্যাপী হরতাল এবং অবরোধ করা হয়, হাফেজ আল আসাদ এর সরকার এর বিরুদ্ধে| এই বিদ্রোহের সমাপ্তি হয়,
১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন হাফেজ আল আসাদ এর সিরিয়ান বাহিনী, হোমস শহর অবরোধ করে ২৭ দিন ধরে| এবং সেই অবরোধে ১০,০০০ মতান্তরে ৪০০০০ হাজার সুন্নি মুসলিম ব্রাদারহুড এর সমর্থক এবং প্রতিবাদ-করি কে হত্যা
হয়|
ইতিহাসে এইটা হোমস মাসাকার নাম পরিচিত|এবং এখনো হোমস মাসাকার আধুনিক আরব ইতিহাসে এইটা সব চেয়ে নৃশংস এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রাণ হানির ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত আছে| হোমস মাসাকার এর উপর সিরিয়াতে সুন্নি বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে|
এরপর থেকে বিগত ৩০ বছর মোটামুটি কোনও অ পজিশন ছাড়াই শাসন করেছে, বাথ পার্টি এবং আলাবী গোত্রের লোক|
২০০০ সালে হাফেজ আল আসাদ তার সন্তান কে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যায়| বাসার আল আসাদ, পাশ্চাত্যতে শিক্ষিত| এবং সে ক্ষমতা গ্রহণের পর, বেশ কিছু রিফর্ম ঘোষণা করে| ন্যাশনাল ডায়লগ করে| গণতন্ত্র আসবে প্রতিশ্রুতি দেয়|
কিন্তু কেমনে কি, আবার সে তার পিতার রূপে ফিরে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে তার পিতার থেকেও ভয়ঙ্কর আচরণ করে|
এই খানে আমাদের ফার্স্ট পার্ট এর সমাপ্তি| এইটা একটা বিশাল পেইন রচনা ছিল, কারণ এইটা ছিল| ইতিহাস|
আমি সেকেন্ড পার্ট এ ইতিহাস এর শিক্ষা গুলো নিয়া কিছু আলোচনা করবো| আশা করি, ঐটা এই পার্ট থেকে কম পেইন হবে|ওই খানে আমরা দেখব কেন আলাবী কোনও মতেই ক্ষমতা ছাড়তে রাজি না| এবং এই যুদ্ধে সিরিয়ার বাকি জনগোষ্ঠীর অবস্থান কি|আমরা আরো প্রশ্ন করবো সব কিছু একেবারে সাদা কালো কিনা|মানে সুন্নি মাত্রই নন বাথিস্ট বা আলাবী মাত্রই আসাদ সাপোর্টার কিনা, নাকি এই যুদ্ধে আরো অনেক কিন্তু আছে|
আমরা এই কেমিক্যাল এটাক টা নিয়া একটু আলোচনা করবো, এবং জানতে চাইব রেড লাইন সেট করে আমেরিকা কি অর্জন করতে চায়|এবং নিরাপত্তা পরিষদ এর মেন্ডেট ছাড়া আক্রমণ এর লিগাল কোন্সিকুএন্সআমরা প্রশ্ন উত্তর সেশন করবো, মার্কিন আক্রমণ নিয়ে, আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও মরাল অথরিটি আছে কিনা, সিরিয়া আক্রমণ করার| এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি চায় ?
এবং যদি সাহস দেন আমরা একটু আত্ম-বিশ্লেষণ করবো, আমরা মুসলমানরা (শুধু সেই সব পাঠক যারা মুসলমান ) কি আসলে অনেক ভালো জাতি হইছি কিনা? এত লম্বা সময় পেইন দেয়ার জন্যে সরি | আশা করি, পরের পর্ব আর একটু কম পেইনফুল হবে|
Informative. Exceptionally well written.