মৃত্যুর মিছিলে আর একটি ছবি, যে কারো সন্তান বা কারো মা
সাভারের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের উদ্ধার কাজ এখনও চলছে। এখনও কিছু কিছু জীবিত দেরকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে। সেই উদ্ধারে দূর থেকে পার্টিসিপেট করতে পারছিনা, তাই একটা ছোট রিসার্চ করে অল্প হলেও আমার দায়টাও নিচ্ছি।
সাভারের রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার আগের দিন, ওই ভবনে ফাটল দেখা দেয়। ওই ফাটল দেখা দেয়ার পরের দিন, ব্র্যাক ব্যাঙ্ক বন্ধ ছিল কিন্ত ওই ভবনের সকল গার্মেন্টস কারখানা খোলা হয় । ব্র্যাক ব্যাঙ্ক যে খুব মানব দরদী এবং কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান তাও না। গার্মেন্টস শিল্প গুলোর মতই ব্র্যাক ব্যাঙ্ক একটি উপার্জনমুখী প্রতিষ্ঠান। তাহলে, দেখা প্রয়োজন ব্র্যাক ব্যাঙ্ক কেন বন্ধ ছিল এবং গার্মেন্টস গুলো কেন খোলা হইছে ?
আলোচনায় আমরা দেখব, বাংলাদেশের গার্মেন্টস এখন ভয়াবহ রকম লাভ জনক। এত বেশি লাভ জনক যে, টাকার লোভ এ মালিক এর হিতাতীত লোপ পেয়ে যায়। লাভ একটা প্রয়োজনীয় জিনিস। কিন্তু দেশের টাক্স ফাকি দিয়ে এবং শ্রমিক রক্ত পানি করা শ্রম এর ন্যূনতম মূল্য পরিশোধ না করে, তাদের ঠকিয়ে এই ভাবে বছর এর পর বছর সুপার নরমাল প্রফিট করা টা, আলটিমেটলি পোশাক শিল্পের মালিক দের বিবেক কে সম্পূর্ণ লুপ্ত করে দিয়েছে। এবং তারা এমন একটা সাইকি তে চলে গেছে যে অবস্থায়, শিপমেন্ট এবং প্রফিট এই হিসেবে বাদে আর সব বিবেচনা এখন আর গুরুত্তপূর্ণ নয়। কিন্তু, একটা শ্রম ঘন শিল্পে ব্যক্তির নিরাপত্তার প্রফিট কে স্থাপন করা একটা চরম অনৈতিক অবস্থান। কিন্তু, বিজেএমইএ এর নেতৃবৃন্দ নিজেরা তো এই অনৈতিক অবস্থান এ থেকে সবাই কে এই পজিসন টাকেই এক মাত্র গ্রহনযোগ্য অবস্থান হিসেবে স্থাপন করছে। এবং মেডিয়া হতে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র সেই অবস্থান মেনেও নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা
আজ থেকে ৮/৯ বছর আগে, পোশাক শিল্পে মারচেন্ডাইজার আর সিনিয়র মার্চেন্ডডাইজার হিসেবে কাজ করেছিলাম বেশ কয় এক বছর। খুব কাছাকাছি থেকে ইন্ড্রাজট্রিটা দেখেছি এবং সজ্ঞানে ঐ ইন্ডাস্ট্রি টা সুইচ করেছি অনেক গুলো কারনে ।
আমি জীবনে অনেক ধরণের চাকুরী করছি, যার মধ্যে অনেক গুলো কঠিন এবং প্রচন্ড ডিমান্ডিং। সব চাকুরির মধ্যে আমার কাছে সব চেয়ে চেলেঞ্জিং মনে হইছে, গার্মেন্টস এর মারচেন্ডাইজার হিসেবে কাটানো চাকুরীর কয় একটা বছর। মনে পরে, তখন স্বপ্নের মধ্যে দেখতাম শিপমেন্ট ফেইল হইছে, ফ্যাক্টরি তে আমার অর্ডার ঢুকে গেছে কিন্তু ওয়ার্কাররা লাইন বন্ধ করে বসে আছে কারন আমার একটা এক্সেসারিয সাপ্লায়ার ডেলিভারি দিতে ফেইল করছে, বায়ার মিটিং এ কস্টিং এর সিটে একটা শুন্য কম দেয়ার কারনে অর্ডার এর ভ্যালু ভুল হইছে এবং তাতে এল সি ভালু ১ লাখ ডলার কমে গেছে, আর ডাইরেক্টর আমার পেছনে খোলামাঠে বন্দুক নিয়ে দৌড়েছে। প্রচণ্ড চেলেঞ্জিং ছিল চাকুরীটা। আমার অফিস ছিল একটা ফাক্টরীর সাথে লাগানো। ফলে, খুব কাছ থেকে দেখেছি একটা ফাক্টরী তে পি এম থেকে শুরু করে একটা সুইং অপারেটর বা হেলপার কি অসম্ভব পরিশ্রম করে। ফলে এই ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্ট সকলকেই, আমি প্রচণ্ড রেস্পক্ট করি মনে মনে ।
সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছু আলোচনা করছি।
আমাদের পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের সব চেয়ে বড় সমস্যা হল, বাংলাদেশের এক একটা গার্মেন্টস ফেক্টরী ভয়াবহ রকম প্রফিটেবল ।
বাংলাদেশে আর কোন ইন্ডাস্ট্রি তে এতো লাভ নাই। ঐ জন্যেই এই ইন্ডাস্ট্রিটা এত বুম করছে। আমি একটা বড় গ্রুপ এ ছিলাম। যে গ্রুপ এ প্রায় ৮০ টা লাইন ছিল। প্রায় ৯ বছর আগে, সেই সময় তাদের টার্ন ওভার ছিল ছিল, প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার এর কাছাকাছি এবং এখন প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার হয়েছে বলে শুনেছি।
ব্র্যাক ব্যাংক কেনো বন্ধ থাকে, কিন্তু গার্মেন্টস কেনো বন্ধ থাকে না সেই আলোচনা করতে গেলে আপনি দেখবেন। ব্র্যাক ব্যাংক এর পোসপাস বেশী থাকতে পারে এবং একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি দেখতে আনকুল এবং খ্যেত মনে হতে পারে কিন্তু রানা সেন্টার এর সুসজ্জিত ব্র্যাক ব্যাংক থেকে তার উপর এর তলার সারি সারি বদ খত মেশিন দিয়ে সাজানো গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি গুলো অনেক বেশী প্রফিটেবল । অনেক অনেক বেশী প্রফিটেবল ।
এই প্রফিটটা বেশি হওয়ার কারণে একটা গার্মেন্টস এর মালিক এর কাছে তার ফ্যাক্টরি এক মিনিটের জন্যে বন্ধ করার স্টেক টা অনেক হাই ।
এ প্রফিট টা এতো ভয়াবহ রকম বেশী যে, এক একজন ফ্যাক্টরি মালিক লোভ এ, কামনায় অন্ধ হয়ে যায়। তার কাছে, একজন ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার হয়ে যায় ক্রিতদাস এর চেয়ে অধম ।মানুষ তার কাছে হয়ে যায়, সংখ্যা। মানবিকতা শুধু মাত্র তার নিজের সন্তানদের জন্যে প্রযোজ্য। বাকি সব তার কাছে, কর্পোরেট সোসিয়াল রেস্পন্সিবিলিটির শো অফ । সামনে সামনে ভদ্র আচরন করলেও , তার মনে এক মাত্র হিসাব থাকে প্রফিতিবিলটি আর শিপমেন্ট। এই খানে মানবিকতার, ন্যায্যতার, নৈতিকতার কোন স্থান নাই।
তাই তারা শ্রমিক দের ফ্যাক্টরির তালা মেরে দরজা আটকে রাখে যেন একজন শ্রমিক এক মিনিটের জন্যে বাহিরে যেতে না পারে। তাই বিল্ডিং এর পিলার এ ফাটল ধরলেও সবাই কে ডেকে এনে কাজে বসায়, তাদের মাথায় ও আসেনা দুর্ঘটনার সম্ভাবনার কথা । কারণ, একজন শ্রমিকের প্রতি মূহুর্তে সুইং মেশিনের এর পুলিতে ববিন এর এক একটা ঘূর্ণন তার কাছে, কাচা টাকা। অনেক অনেক টাকা। যে টাকার লোভ সামলানো মুশকিল। তাই সে কোনমতোই তার ফাক্টরী বন্ধ হতে দিবেনা।
ব্যাক্তির এবং প্রতিষ্ঠান এর প্রফিট করাটা আমি অন্যায় মনে করিনা। কিন্তু অতিরিক্ত প্রফিট খারাপ। কারণ, অতিরিক্ত প্রফিট অতিরিক্ত লোভ এর জন্ম নেয় । এবং অতিরিক্ত লোভ থেকে মানুষের হিত অহিত এর বোধ লোপ পায় ।
একটু আমরা দেখি একটা গার্মেন্টস কি পরিমান লাভ করে।
এই লাভ টা যে মাত্রাতিরিক্ত বেশি সেটা বোঝার জন্যে আমি আজকের হিসেবে, একটা আট লাইনের গার্মেন্টস ফাক্টরীর প্রফিট কেলকুলেট করব। আপনারা দেখবেন, একটা ফাইভ পকেট জিন্স এর একটা অর্ডার করতে একটা ফ্যাক্টরি কি পরিমান প্রফিট করে । আমরা ছেলেরা যে জিন্স প্যান্টগুলো পরি -তাই গার্মেন্টস এর পরিভাষায় ফাইভ পকেট জিন্স ।
আমাদের শিল্পীরা
হিসাব টা আমি করব সি এম দিয়ে। সি এম হচ্ছে, কাটিং এবং মেকিং চার্জ। একটা ফাইভ পকেট জিন্স এর সি এম ১.২ ডলার থেকে শুরু করে ২.৫ ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
স্পেশিয়াল কেস এ, এইটা ৫ ডলার ও হতে পারে, কিন্তু সেইগুলো স্ট্যান্ডার্ড হিসেব নয়। আমি হিসেব এর সুবিধার জন্যে, ধরবো একটা ফাইভ পকেট জিন্স এর সি এম ,১.৫ ডলার। এবং একটা ৬৫ মাশিনের এর স্ট্যান্ডার্ড ফ্যাক্টরির, ফাইভ পকেট জিন্স এর দৈনিক প্রডাক্টিভিটি ১০০০ থেকে ১২০০পিস হওয়ার কথা । আমি ধরবো ৯০০ পিস, যেইটা কম ও না বেশীও না।
একটু বলে নাই। ঐ ধরনের হিসেব কখনোই একুরেট হয়না। এবং আরো বলে রাখি এই হিসেবেটা যারা ডাইরেক্ট বায়ার বা বায়িং হাউসে দিয়ে ইন্টারমেডিয়ারি হিসেবে কাজ করছে তাদের জন্যে প্রযোজ্য, সাব কন্ট্রাক্ট ফ্যাক্টরি গুলোর প্রফিট অনেক কম হয়।
যাই হোক, হিসাব টা দেখেন।
কাটিং এন্ড মেকিং চার্জ সর্ব নিম্ন ১ ডলার ৭৭ টাকা
নেট প্রফিট ১৫% অফ সি এম ১১.৫৫ টাকা
একটা ৬৫ মেশিন স্ট্যান্ডার্ড লাইন এর দৈনিক প্রোডাক্টিভিটি ১০০০ পিস
একটা স্ট্যান্ডার্ড লাইন এর দৈনিক লাভ ১০০০ পিস x ১১.৫৫টাকা =১১৫৫০ টাকা
ছোট একটা ৮ লাইনের ফ্যাক্টরির দৈনিক লাভ ১১৫৫০ টাকা x ৮ লাইন = ৯২,৪০০ টাকা
মাসিক লাভ ২,৪০২,৪০০টাকা বা, ২৪ লক্ষ টাকা
বছরে যা হবে, ৩ কোটি টাকার কাছাকাছি।
লাইন বাড়লে প্রফিট আরো বেশী হবে । এবং আমাদের দেশের হিসেবে ৮ লাইন আর ফ্যাক্টরিকে ছোট ফ্যাক্টরি হিসেবে ধরে হয়।
এই হিসাব টা অনেক কঞ্জার্ভেটিভ হিসেব করছি। ঐ লাভ টা আরও অনেক দিক দিয়ে বারে এবং ক্ষেত্র বিশেষে ডবলও হতে পারে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কমতেও পারে, কিন্তু সেইটা এক্সেপ্সান ।
এবং ঐ প্রফিট টাকে ধরে রাখার জন্যে জন্যে,প্রতি টা ফ্যাক্টরি ভয়াবহ রকম ওভার বুকিং করে থাকে
একজন বায়ার এর কাছে তার ঠিক টাইম এ শিপমেন্ট খুব ক্রিটিকাল একটা ইস্যু। কারণ ইউরোপে, আমেরিকা তে কাপড় কেনা বেচা হয় সিজন অনুসারে। শিপমেন্ট এক দিন দেরিতে পৌছালে, তার সেল এ লস।
ফলে দেখা যায় , ওভার কাপাসিটি বা প্ল্যানিং এর ভুল এর কারণে, একটা ফ্যাক্টরিতে সব সময় শিপমেন্ট ডিলে হওয়ার ভয় এর মধ্যে থাকতে হয়। কারন ফ্যাক্টরি মালিক অর্ডার নেয়ার সময় ৯০% ক্ষেত্রে কন্টিনজেন্সি বা দুর্যোগ এর জন্যে আলাদা হিসাব রাখেনা।
ফলে হরতাল হোক, আগুন হোক, বিল্ডিং এর পিলার ধ্বসে পরুক -ফ্যাক্টরি মালিক এর প্রতি দিন ফ্যাক্টরি চালু রাখার বাধ্যবাধকতা থাকে। ঐ খানে মানবিকতা,হেলথ এন্ড সেফটি কোন ইস্যু থাকেনা । এবং একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির একমাত্র কন্সিদারেশান থাকে –বায়ারের শিপমেন্ট।
বাংলাদেশের মতো দুর্যোগ পূর্ণ দেশে, সারা বছর এই ধরনের অপ্টিমাল লেভেল এ ফ্যাক্টরি চালানোর এই প্রবনতার মধ্যে শ্রমিকের প্রতি সামান্য মানবিকতা দেখানোর সুযোগ থাকেনা ।
তাই ঘুরে ফিরে দেখবেন, অদক্ষতা তো আছেই কিন্তু লোভ ই হয়ে পরে ঐ দুর্ঘটনা গুলোর মূল নিয়ামক।
তাই দেখবেন, একটা গার্মেন্টস এ আগুনে পুড়ে , ১২০ জন মানুষ মরে যাওয়ার পরেও একজন মালিক এর চিন্তা থাকে তার শিপমেন্ট কয়টা মিস হইলো। তার কয়টা এল সি মিস গেল। একটা শ্রমিক মরলে, ১০টা আসবে। কিন্তূ একটা বায়ার এর শিপমেন্ট মাইর গেলে, সেই বায়ার আর না ও আসতে পারে।
ফলে একটা অমানবিক এবং অসম্ভব সিস্টেম আর উপর পুরো ইন্ডাস্ট্রিটা দাঁড়ানো।
এবং এই প্রফিট এর উপর গার্মেন্টস মালিকরা এক টাকাও কর্পোরেট ট্যাক্স দেয় না।
এইটার জন্যে আমাদের দেশের প্রতিটা পোশাক মালিকরা একটা টেকনিক এপ্লাই করে। যা বাংলাদেশের প্রতিটা ইনকাম ট্যাক্স এর লোক এর জানা, ব্যান্ক এর লোক এর জানা, সবার জানা শুধু অর্থমন্ত্রী ছাড়া ।
সেইটা হলো, পোশাক শিল্প এক্সপোর্ট অরিয়েন্টেড হওয়ার কারনে, পাঁচ বছর পর্যন্ত ট্যাক্স সুবিধা পায়। (ঐ বছর এর হিসেব টায় একটু ভুল হতো পারে) মালিকেরা যেইটা করা, তা হইলো, ঐ ফ্যাক্টরি টারে,ট্যাক্স হলিডে এক্স্পায়ারী পর্যন্ত প্রফিটেবল দেখায়। তারপর যখন ট্যাক্স হলিডে শেষ হয়, ওই সেম জায়গায় সেম ফেক্টরিকে তারা নাম পাল্টায় এবং আরেকটা নামে এনলিস্ট করে।এবং পুরান ফ্যাক্টরি কে লুজিং হিসেবে দেখায়। এবং এক টাকাও দেশ কে কর্পোরেট ট্যাক্স দেয় না তারা।
শুধু মাত্র, এল সি ভালু থেকে সরকার একটা এই আই টি (advanced income tax)কেটে রাখে। যেইটা আগেছিল .৫ যা লাস্ট বাজেটে বাড়িয়ে বোধ হয় ১%(ফিগার টা একটু এদিক ওদিক হতে পারে) করে হইছে। এই সিদ্ধান্ত টাকে আমি আমাদের অর্থমন্ত্রীর বিগত পাচ বছরের এক মাত্র ইনটেলিজেন্ট সিদ্ধান্ত বলে মনে করি।
প্রফিট করা কোন অন্যায় না। অর্থনীতি কে সামনে আগাতে হলে, নতুন ইনভেসমেন্ট এবং ক্যাপিটাল একুমুলেশানের জন্যে প্রফিট খুবই প্রয়োজনীয় একটা জিনিস।
কিন্তূ, দেশের সস্তা শ্রম এর সুযোগ নিয়ে, দেশের প্রতি কোনো দায় পরিশোধ না করে, এতো প্রফিট করার পর ঐ শ্রমিক গুলোর প্রতি সামান্য দায়বধ্যতা না দেখানোটা ভয়াবহ একটা অন্যায়। তাই দেখা যাচ্ছে, ঘুরে ফিরে সমস্যা একটাই অতিরিক্ত প্রফিট।
ঐ লোভ কে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, কিন্তু দেশের নাগরিক যেন ঐ লোভ এর বলি না হয় সেটা দেখার দায় কিন্তু রাষ্ট্রের।
এই জন্যেই রাষ্ট্রকে আইন সৃষ্টি করতে হয়। একটা প্রতিষ্ঠান এর নিয়ম কানুন কি হবে, শ্রমিক অন্যায় এর শিকার হল তার প্রটেকশান কোথায় চাইবে , তার শ্রম এর মুল্য কত হলে ন্যায্য হবে, তাকে কি কি সুবিধা দিতে মালিক বাধ্য থাকবে, শ্রমিক কি কি সামাজিক নিরাপত্তা পাবে ।
কিন্তূ, ঠিক এই কাজ গুলোই বাংলাদেশে ন্যায্য ভাবে, সমতার ভিত্তিতে হয় নাই। ২০০৬ সালে বাংলাদেশে লেবার ল করা হইছে বটে কিন্তু তা সম্পূর্ণ ভাবে মালিক এর স্বার্থ রক্ষার জন্যে সৃষ্ট-এবং পোশাক মালিক এর সীমাহীন প্রফিট টাকে প্রটেকশান করার পারস্পেক্টিভ থেকেই ঐ ২০০৬ এর লেবার ল করা হইছে।
যেমন বাংলাদেশের লেবার ল তে অনেক ভাল ভাল কথা বলা আছে, কিন্তু শ্রমিক দের পেনশন বা গ্রাচুইটি নামক কোন কনসেপ্টই নাই। ইউরোপ আমেরিকা বাদ দেন , ইন্ডিয়া তেও লেবার লতে শ্রমিকদের যত টুকু প্রটেকশান দেয়া হইছে, তার সামান্য টুকু বাংলাদেশের লেবার ল তে নাই।
ফুলে শুধু গার্মেন্টস নয়, বাংলাদেশের অন্যান্য কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান সহ সকল প্রতিষ্ঠানেই শ্রমিক এর উপর একটা ভয়াবহ শোষণ নিশ্চিত করা হইছে ২০০৬ এর লেবার ল এর মাধ্যেমে।শুধু পোশাক শিল্প নয়, নামকরা বিদেশি কর্পোরেট কোম্পানিতে, এই লেবার লকে দিয়ে কিভাবে নিম্ন আয় এর কর্মীদের উপর শোষণ করা হয় তা সচক্ষে দেখছি।
বিজেএমইএ।
মালিক দের স্বার্থরক্ষার জন্যে গড়া প্রতিষ্ঠান কে দিয়েই যদি ঐ লোভ কে নিয়ন্ত্রন করতে হয় তো যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তার সবচেয়ে চমৎকার এক্সাম্পল বিজেএমইএ। ।যার প্রথম কাজ হচ্ছে ডিনায়েল এর জন্যে গ্রাউন্ড সৃষ্টি করা এবং মালিক এর স্বার্থ রক্ষা করা। বিজেএমইএ কোন দিন , শ্রমিক দের স্বার্থ রক্ষা করবেনা।
বিজেএমইএ পারসেপশন মেনেজ এ ব্যস্ত
এইটা তাদের কাজই না। কারন আমাদের দেশের পোষাক শিল্প যেই নীতির ভিত্তিতে দারাইছে তার এসেন্স টাই হলো, মালিক এবং শ্রমিক প্রতিপক্ষ। মালিকএর কাজ হইলো তার অসীম লোভ টাকে নিবৃত্ত করার জন্যে সর্ব নিম্ন মজুরি দিয়ে শ্রমিকের উপর সরবোচ্চ শোষণ নিশ্চিত করা । আর শ্রমিক এর স্বার্থ হচ্ছে, এই কাজ এর জন্যে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা। কিন্তু, আমাদের দেশে মালিক পক্ষ সুসংগঠিত কিন্তু শ্রমিক পক্ষকে সংগঠিত হওয়ার সব চেষ্টা বিজেএমইএ চতুরতার সাথে বন্ধ করে রাখছে। এবং সেই জন্যে তারা তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে চরম ভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।
তাই শ্রমিক এর স্বার্থ রক্ষার জন্যে প্রয়োজন ট্রেড ইউনিয়ন। কালেক্টিভ বারগেইনিং রাইটস- বাজার অর্থনীতির ভারসাম্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ পিলার ।
এখন তাই ট্রেড ইউনিয়ন একটা মাস্ট।
ট্রেড ইউনিয়ন
মানুষের প্রকৃতির সীমাহীন লোভ এর যে বৈশিষ্ট্য, তার থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। তাই, মালিক এর হাত থেকে শ্রমিক রে রক্ষা করার জন্যে বাজার অর্থনীতির মৌলিক একটা নিয়ম হইলো, কালেক্তিভ বারগেইনিং রাইটস বা ট্রেড ইউনিয়ন এর অধিকার ।
ট্রেড ইউনিয়ন যদি থাকে তো শ্রমিকেরা নিজেদের দাবী গুলো নিয়ে সংগঠিত হয়ে, মালিক দের সাথে দেন দরবার করতে পারবে।
এইটা বিজেএমইএ জানে। ঐ জন্যে তারা ভুজুং ভাজুং বলে এতো দিন ধরে এইটা ঠ্যাকায় রাখছে। তারা বলে আমাদের শ্রমিকেরা এখনও রেডি না। তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয় । তাদের ট্রেড ইউনিয়ন দরকার নাই এবং মালিক রাই তাদের স্বার্থ নিশ্ছিত করবে। এইটা একটা পিউর বুলশিট।
প্রতিটা মানুষ জানে, সে কি চায়। প্রতিটা মানুষ তার হিস্যা আদায় করার জন্যে দাবী জানাতে সক্ষম। পোশাক শ্রমিকরাও তার ব্যাতিক্রম নয়। সংগঠিত নয় বলেই বিজেএমই এত দিন এই অন্যায় টা চালু রাখতে পারছে। এইটা চালু রাখাই ট্রেড ইউনিয়ন এর দাবী না মানার এক মাত্র কারন।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প,ইনফান্সি স্টেজ পার হয়ে গেছে।
আজ থেকে ১০ বছর আগে আমি যেই সব ফ্যাক্টরি বা গ্রুপ দেখছি, ৮ বা ১০ লাইন এর, তার প্রতি টি এখন, ৩০ থেকে ৪০ লাইন হয়ে গেছে। মালিক দের অন্তরদন্দের কারনে বিপর্যস্ত হওয়া ফ্যাক্টরি বাদে সবফ্যাক্টরি আগাইছে। এবং আগাচ্ছে।
আমাদের ব্যাক ওয়ার্ড লিঙ্কেজ এখন অনেক গভীর। এখন ঐ ইন্ডাস্ট্রি পপাত ধরণী তল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। বরং ক্রিতদাসি শ্রমিক দের নিয়ে আন্তর্জাতিক যে প্রচারনা,তা অত্যন্ত সত্য এবং বাস্তব- সেই নেগেটিভে ইমেজ টাই আজ আমাদের পোশাক শিল্পের সব চেয়ে বড় শত্রু।
পোশাক শিল্প কে বাচাতে হবে। এবং বাচাতে হবে মালিক দের হাত থেকেই।
পোশাক শিল্প, আমাদের অর্থনীতির লাইফ ব্লাড । পোশাক শিল্প কে বাদ দিলে বাংলাদেশ সোমালিয়া হয়ে যাবে। দুর্ভিক্ষ সহ ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। আমাদের সুশিল সমাজ, মধ্যবিত্ত সমাজ, হালের কর্পোরেট বেনিয়াদের সারভ করা শহুরে হাই ফাই সমাজ- সবার অর্থনৈতিক ভিত্তি এই পোশাক শিল্প। এবং পোশাকশিল্প ধ্বসে পরলে এর সব কিছুই ধবসে পরবে। আমাদের পুরো সমাজের এবং রাষ্ট্রের স্ট্রাকচার ধ্বসে পরবে। কিন্তু পোশাক শিল্প কে এখন বাচাতে হবে, মালিক দের হাত থেকেই। কারন, এই মালিকেরাই আজ পোশাক শিল্প টাকে ধংশ করে দিচ্ছে।
বিজেএমইএ এর নেতারা ক্যামেরার সামনে আসলে যে বলেন, সোনার ডিম পাড়া হাস কে মেরে ফেলবেন না সেইটা একটা ভয়াবহ শঠতা ।
কারণ, কেও যদি দায়ি হয় , বিজেএমইএ নিজেই সোনার ডিম পাড়া হাসকে মেরে ফেলার জন্যে দায়ী হবে । কারণ, সোনার ডিম টা পারছে কে? ঐ শ্রমিকেরা। অবশ্যই একজন উদ্যোগতার কর্ম, পরিশ্রম এবং ঊদ্ভাবনি শক্তি দিয়ে, একটা ফ্যাক্টরি দাড়ায় যাতে, শ্রমিক দের কর্ম সংস্থান হয়। সেইটা কোন মতোই অস্বীকার করা যাবেনা।
কিন্তূ, বিজেএমইএ এর মালিকেরা যেইটা বুঝতে চান নে সেইটা হইলো, এই দেশে তাদের এন্টারপ্রাইজ এর মূল চালিকা শক্তি , শ্রমিক দের সস্তা শ্রম ।উনাদের উদ্যোগ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু উনারা ব্যক্তি হিসেবে উদ্যোগ না নিলে অন্য কেও উদ্যোগ নিতো ।কিন্তূ, ঐ সস্তা শ্রম প্রদান কারী শ্রমিক যদি না থাকে তো, ঐ ইন্ডাস্ট্রি টিকে না।
আমাদের নাটক, সিনেমাতে পোশাক মালিক দের সম্পর্কে একটা ধারনা মাঝে মাঝে প্রকাশ করা হয়।
সেইটা হলো , হঠাৎ টাকা পাওয়া অশিক্ষিত লোক জনেরাই গার্মেন্টস এর মালিক হয়। এইটা একটা এবসলিউটলি ভ্রান্ত দেরনা। পোশাক শিল্পের ৯৯% মালিক উচ্চ শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত ফ্যামিলি থেকে উঠে আসছে । ঐ শ্রেণীর মধ্যে , একটা ব্যাপক শ্রেণী উন্নাসিকতা আছে। যেই, দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা রিকশাওয়ালা দের নিম্ন জাত এর মনে করি, ঘর এর বউ এর সোনার গয়না হারিয়ে যাওয়ার পর কাজ এর মেয়ের কপালে গরম শিক দিয়ে সেঁক দিয়া স্বীকারোক্তি আদায় করি-সেই শ্রেণী মানসিকতা নিয়ে একজন পোশাক মালিক তার শ্রমিক দের দেখে।
এই শিক্ষা সে তার ছোটকাল থেকে তার পরিবার থেকে পায় , সমাজ তার মনে প্রথিত করে এবং রাষ্ট্র তাকে সেই বিভাজন বেচে এবং শোষণ কে উপজিব্য করে পয়সা কামানোর ক্ষেত্র তৈরী করা দেয়।
এর থেকে মুক্তি পাওয়ার এক মাত্র উপায় পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়নের অনুমোদন দেয়া এবং রাষ্ট্রকে একটা সুন্দর জীবনের মিনিমাম চাহিদা হিসেবে করে ন্যায্যতার ভিত্তিতে শ্রমিকের শ্রম এর ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া । এবং এমন একটা সীমা নির্ধারণ করা যাতে, পোশাক শিল্পে মালিকের যে সুপার নরমাল প্রফিট তার একটা বড় অংশ স্রমিকের হাতে পৌছায় –এর ফলে রিপল ইফেক্ট এ বাংলাদেশের অর্থনীতি দারুনভাবে বেনেফিটেড হবে এবং কারখানায় শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। এবং পোশাক শিল্প ভয়াবহ
একটা অন্যায় থেকে মুক্তি পাবে। সোনার ডিম পারা হাস টাকে আমাদের সবার বাঁচিয়ে রাখতে হবে, সুন্দর মত খাইয়ে পরিয়ে।
আমাদের শ্রমিক দের স্বার্থ আমাদের কেই রক্ষা করতে হবে, বিজেএমই এর উপর নির্ভর করলে চলবেনা ।
পরিশেষে আমি এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে নিহত সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। এখনও উদ্ধার কাজ চলছে। এখনও হয়তো কিছু প্রান বাচানো সম্ভব এবং আমাদের সবার উচিত যে যা পারি, এই উদ্ধারকাজ এবং এই অসহায় মানুষ গুলো কে সহায়তা করা ।
এবং এই উদ্ধার কাজ শেষ করা মাত্র আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রি তে লেবার রাইটস, হেলথ অ্যান্ড সেফটি ইসু, সম্মান জনক মজুরি সহ সকল ইসু তে একটা নাশনাল ডায়ালগ সুচনা করতে হবে এবং তার আলোকে কার্যকর স্টেপ নিতে হবে । বিজেএমইএ এর শঠতা পূর্ণ চালবাজিতে, পারসেপ্সান মেনেজ করে ইসু গুলো কোন মতে বাইপাস করে গেলে চলবেনা।
এরা প্রচুর প্রফিট করছে। এবং বেশি প্রফিট করতে করতে তাদের আশনাই বেড়ে গেছে। এখন তাদের দেয়ার সময় আসছে। এখন প্রকৃত স্টেপ নিতে হবে। আমাদের শ্রমিকদের স্বার্থ আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে, বিজেএমইএর উপর নির্ভর করলে চলবেনা । এবং যা করার এখনই করতে হবে। কোন পরে ফরে না।
এত বড় অনৈতিকতার উপর দাড়িয়ে এত বড় অনায্যতা আর চলতে দেয়া যায়না।
মুখের ভয় এবং শোক টা দেখুন