পরশু রাতে প্রথম আলোর একটা নিউজ পড়ে ভয়াবহ বিষণ্ণ হয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, হয়তো ঘুম থেকে উঠে দেখবো নিউজটা ভাইরাল হয়ে গ্যাছে।
কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে লগ ইন করে দেখলাম না কোন আলোচনা নেই। এমন কি প্রথম আলোর প্রথম পেজেও নিউজটা আর নেই, অন্য অনেক নিউজের আড়ালে হারিয়ে গ্যাছে। নিউজটার টাইটেল ছিল, এক কক্ষে বাবা, অন্য কক্ষে ছেলের ঝুলন্ত লাশ( কমেন্ট লিঙ্কে) এই দেশে এখন হত্যা আত্মহত্যা ঘটে।
কিন্তু জানিনা কেন, গত দুই দিন ধরে সংবাদটা আমাকে তাড়া করে বেরিয়েছে। মগবাজারের নয়া-টোলার ভাড়া বাসায় খায়রুল ইসলামের (৫৫) লাশ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছিল। পাশের কক্ষে একইভাবে ঝুলছিল সন্তান শাহরাব হোসেন ওরফে অরিনের (১৪) লাশ। পুলিশ বলেছে, খায়রুল ইসলাম ঠিকাদার ছিলেন। ব্যবসায় বিপুল অঙ্কের টাকা লোকসান হওয়ার পর থেকে তিনি মানসিক রোগে ভুগছিলেন। তাঁর ছেলে শাহরাব অটিস্টিক ছিল। খায়রুল একসময় ঠিকাদারি করতেন। তবে কোটি টাকা লোকসান করে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।…… আর্থিক সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় কয়েক মাসের বাসা ভাড়াও বকেয়া পড়েছিল… ধারণা করা হচ্ছে, ছেলেকে হত্যার পর খায়রুল নিজে আত্মহত্যা করেছেন একজন ঠিকাদার। কোটি টাকা মূল্যের ব্যবসা করতো। একজন সমর্থ মধ্যবিত্ত নয়, একজন উচ্চ মধ্যবিত্ত। সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব। বাসা ভাড়া দেওয়ার সক্ষমতা নাই। জানিনা কেন, আমার বারে বারে মনে পরছে এই লোকটা তার ছেলে কে হত্যা করার সময়ে কি যন্ত্রণা অনুভব করতেছিল। একজন বাপের জন্যে একটা ছেলেকে হত্যা করা কত কঠিন। কিন্তু, খায়রুল ইসলাম হয়তো জানতো সে আত্মহত্যা করলেও, তার ১৪ বছর বয়সী অটিস্টিক ছেলেকে দেখার মত কেউ। নাই। তাই সে ছেলেকে হত্যা করে, নিজে আত্মহত্যা করে।সেচ্ছা মৃত্যু বেছে নেওয়ার আগে, এই ভাবে নিজের ছেলেকে হত্যা করেছে যেন তার মৃত্যুর পরে এই অটিস্টিক ছেলের যেন অভাবে অনটনে কোন ধরনের সাপোর্ট ছাড়া বাবাকে ছাড়া বেচে থাকার যন্ত্রণা বইতে না হয়।
মারকেজের একটা উক্তি আমার খুব প্রিয়, যে আমরা আমাদের সন্তানদের ভালোবাসি কারণ এই না যে ওরা আমাদের সন্তান। বরং আমরা ওদের ভালোবাসি তার কারণ আমরা ওদের সাথে আমাদের যাপিত জীবনের অনেক বড় একটা অংশ কাটাই। আমার মনে হয়, যাদের সন্তান অটিস্টিক বা কোন ধরনের শারীরিক বা মানসিক সীমাবদ্ধতা থাকে তাদের সাথে তাদের বাবা মায়ের সম্পর্ক আরো অনেক গভীর হয়। কারণ, তারা এই সন্তানদের অনেক বেশী টেক কেয়ার করে। তাদের প্রতি মমতা বেশী থাকে। কিন্তু ব্যবসায় সব হারিয়ে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত একজন বাবা তার অটিস্টিক ছেলেকে হত্যা করে, নিজে আত্মহত্যা করেছে এই নিউজটা আমি মন থেকে তাড়াইতে পারতেছিনা। গত কয়েক দিনে আমার ছেলেদেরকে কয়েকবার আরো জোরে আঁকড়ে ধরেছি যে আমি কি লাকি। আমার এই লোকটার মত চিন্তা করতে হয় নাই। কিন্তু কি রাষ্ট্র আমরা তৈরি করেছি ? একজন অটিস্টিক সন্তানের বাবা , একজন কোটি টাকার ব্যবসা করা ব্যক্তি বাসা ভাড়া দিতে পারতেছেনা, তাই মানসিক যন্ত্রণায় নিজের অটিস্টিক ছেলেকে হত্যা করে নিজের আত্মহত্যা করেছে। কারো কোন বিকার নাই। উন্নয়ন শীৎকারে চারি দিক বিদীর্ণ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে যে কি ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে সেইটা আমি ১৩০০০ কিমি দূর থেকে টের পাচ্ছি। আমাকে গত কয়েক দিনে অন্তত পাঁচ জন ফোন করেছে, ভাইয়া একটা চাকুরীর ব্যবস্থা করেন। প্রত্যেকটা ছেলে, অসম্ভব মেধাবী। আমার থেকে অনেক অনেক গুন মেধাবী। তাদের নিজের ডিসিপ্লিনে এক দম টপ লাইনার।কিন্তু আমি কি চাকুরী দিবো। কিন্তু আমি সরাসরি না বলি না, কষ্ট পাবে। আমি বলি সিভি পাঠান। আমি চেষ্টা করবো। কিন্তু ইন রিয়ালিটি আমি কি চেষ্টা করবো ? কে আমার রেফারেন্সে চাকুরী দেবে ? আমি জাস্ট প্রবোধ দেই, সিভি পাঠান চেষ্টা করে দেখি। বারে বারে মনে পড়ে একটা সেক্টরের সব চেয়ে মেধাবীদের যদি এই বিপর্যয় হয় তবে বাকিদের কি অবস্থা ? আমার বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন যাদেরই ব্যবসা বাণিজ্য আছে সবাই বিপর্যয়ে আছে। এক মাত্র সরকারি চাকুরী ছাড়া কেউ ভালো নেই। আমার সরকারি চাকুরে বন্ধুরা মেসেঞ্জার গ্রুপে এসইউভি কেনার ছবি দিচ্ছে। ওরা ফাইন। কিন্তু বাকিরা ? আমার একজন নিকটাত্মীয়ের স্কুল আছে। তার স্কুলে ৫০% ছাত্র ছাত্রী এখনো বেতন দেয় না। নিজের জমানো টাকা দিয়ে প্রথম কিছু মাস শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বেতন দিয়েছেন। এখন তাও পারছেন না। তাই টিচারদের অর্ধেক বেতন দিচ্ছেন। বললেন, আমি তো তাও দিচ্ছি, অনেক বড় বড় স্কুল বাড়ি ভাড়া পোষাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গ্যাছে। অনেক নাম করা স্কুল। সবাই এক নামে চেনে। কিন্তু ছয় মাস ধরে বন্ধ।
বাংলাদেশের সার্ভিস সেক্টর যা জিডিপির ৫৫% এর উপরে তার প্রায় প্রতিটা ইন্ডাস্ট্রি – ট্যুরিজম এবং হস্পিটালিটি থেকে শুরু করে মেডিকাল- সব গুলো সেক্টরে অবস্থা খারাপ। আমি অনেক পরিবারকে চিনি যারা গ্রামে ফিরে গ্যাছে। অথবা চাকুরী হারিয়ে শহরেই স্ট্রাগল করছে – কিন্তু তাদের বাস্তবতা উপেক্ষা করে সরকার হতে শুরু করে অর্থনীতিবিদ সকলেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া থেকে এগিয়ে গ্যাছে- আমরা পৃথিবীর সর্বোচ্চ উন্নয়নের দেশ।এই উন্নয়নের আড়ালে কত খায়রুল ইসলাম নিজের ছেলেকে হত্যা করে আত্মহত্যা করছে কত পরিবারে মেয়েকে বাল্য বিবাহ দিয়ে দিতে হচ্ছে, কত পরিবারে ১৪ বছরের মেয়েকে সৌদি আরবে পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে গৃহপরিচারিকা হিসেবে ১৮বছর বয়স দেখিয়ে, কত মেধাবী তরুণ পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে মনোকষ্টে কিভাবে পরিবারের কাছে মুখ দেখাবে এই ভেবে সেইটা কেউ জানে না।
আমি এমন একটা দেশে থাকি যেখানে সরকার প্রতিটা নাগরিককে চাকুরী হারালে মাসে অন্তত ৪০ হাজার টাকা দেয়, তার দিন গুজারের জন্যে কিন্তু তবুও প্রতি দিন সংসদে আলোচনা হয়, টিভিতে টক শোতে অর্থনীতিবিদেরা আলোচকেরা ফেনিয়ে উঠে সরকার কেন যথেষ্ট করছেনা এবং আর কি কি করলে, মানুষকে এই দুর্যোগ থেকে রিকাভার করা যায় সেই পরিকল্পনায়। কিন্তু আমার দেশের মানুষ রাষ্ট্রের কাছে কিছু পায় না বরং এক বিকলাঙ্গ উন্নয়ন ধর্ষণে প্রতিদিন ধর্ষিত হচ্ছে। কিন্ত আমাদের বলা হচ্ছে ইন এভিটেবল রেপ এঞ্জয় করতে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, ফ্রান্সের রানি ম্যারি এন্টিয়নেটের ওরা সবাই কেক খায় না কেন দাবী, বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়নের বড়াই এর চেয়ে কম নিষ্ঠুর ছিল।