বাংলাদেশে ৪০ বিলিয়ন ডলার চাইনিজ ইনভেস্টমেন্ট একটা একটা মিথ।

বাংলাদেশ সরকারের” পাবলিক বলদিকরন” প্রকল্পের সফলতার অন্যতম কারন বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা এবং অত্যন্ত সিনিয়র সাংবাদিকের এবং প্রতিষ্ঠান গুলো ফ্যাক্ট এবং ফিকশন বা মিথের পার্থক্য করতে পারেনা।

নাম ধরেই বলি যে, এই প্রবণতার মধ্যে আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় মানবজমিনের মতিউর রহমান চৌধুরী, প্রথম আলোর মিজানুর রহমান বা বিবিসি, ডয়েচে ভ্যালেকেউ বাদ নাই। জনকণ্ঠ বা ভোরের কাগজ বাদই দিলাম।

উনাদের আর একটা গুন হচ্ছে, তারা কিছু মিথ এবং ধারনা গত এবং কম ওজনদারি ঘটনাকে আলোচনা করতে করতে খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবেন । কিন্তু, যে গুলো সবার সামনে দেখা যাচ্ছে যে ঘটনা গুলোর গুরুত্ব অনেক বেশি সেই গুলোকে আমলে নেবেন না। এবং এই সব ক্রিটিকাল কিন্তু দিনের আলোর মত পরিষ্কার বিষয় গুলোকে অনুল্লেখ করার কারনে পাবলিক ডিসকোর্স থেকে হারিয়ে যায়। এবং পারসেপ্টরি বিষয় গুলো প্রধান বিষয় হয়ে উঠে।

আমার এই আলোচনাটার সূত্র গতকাল , সাউথ এশিয়া মনিটরে মতিউর রহমান সাহেবের লেখা শেখ হাসিনার সামনে অগ্নি পরীক্ষা আর্টিকেলটা। https://bit.ly/2E6z0Nz। কিন্তু, প্রথম উদাহরণটা দেব ডয়েচে ভ্যালে ইংরেজি একটা নিউজ দিয়ে। গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশি সাংবাদিক বন্ধুর লিখিত Is Bangladesh falling into a Chinese ‘debt trap’? টাইটেলের এই এনালিসিসটা-” বাংলাদেশে চায়নার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে ইনভেস্টমেন্ট হচ্ছে”- বিগত কয়েক বছরের বহুল কথিত এই মিথে প্রাতিষ্ঠানিকিকরন বলা যায়। https://bit.ly/34qXhIK

যদিও আর্টিকেলটাতে কয়েক জন স্থানীয় এনালিস্টের বক্তব্যের মাধ্যমে চাইনিজ ডেবট ট্র্যাপ পড়া না পড়ার প্রশ্নটা ব্যালেন্স করা হয়েছে কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এতো টুকু পড়ে না। চায়নার উপরে ঝুঁকে পরা না পরা নিয়ে বিতর্কে আমার বন্ধুরা প্রায়ই ডয়েচে ভ্যালের এই আর্টিকেলটা রেফার করেন। এই ছাড়াও আমি অনেকের মুখে শুনেছি, বাংলাদেশে চায়নার প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট আছে।কিন্তু, বাংলাদেশে এই ৪০ বিলিয়ন ডলার চাইনিজ ইনভেস্টমেন্ট একটা একটা মিথ।

ফলে এই খানে ফ্যাক্ট কি ? ফ্যাক্ট হচ্ছে, ২০১৬ সালে চিনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সফরের সময়, ২৪.৪৫ বিলিয়ন ডলারের ২৭ টি এমওঈঊ স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবে, গত ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত চায়না এই প্রকল্পগুলির জন্য ১ বিলিয়ন ডলারেরও কম ইনভেস্টমেন্ট করেছে। ঠিক কোন কোন প্রোজেক্টে এই ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়া হয়েছে। তার লিস্টটাও আছে।(সংযুক্ত ছবি)। এই নিউজের সোর্স ও কিন্তু, ডেইলি স্টার।

https://bit.ly/2YoamP7 ডেইলি স্টারের এই এক্সেলেন্ট রিপোরটিতে বলা আছে কেন এতো বছরে এক বিলিয়নের উপরে ঋণ ছাড়া হয় নাই। চাইনিজ কোম্পানি গুলো ডকুমেন্টেশানের সময়ে বিভিন্ন ভুল ভাল দেখায়, কাগজ ফেরত পাঠায় এবং ঋণ আটকে দেয়।

২০১৯ অক্টোবারের পরে, আজকে আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত হয়তো এই লিস্টে হয়তো আর .৫ বিলিয়ন ডলার যুক্ত হবে। কিন্তু, আমি দেখেছি, এই লিস্টের প্রোজেক্ট গুলোর নাম ধরেই সবাই বলে থাকে , ওই দেখেন চায়না বাংলাদেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট করতেছে কর্ণফুলী টানেল করতেছে, পদ্মা ব্রিজে সংযোগ সড়ক করতেছে, পাওয়ার সেক্টরে ইনভেস্ট করেছে । ৪০ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট। কিন্তু যোগফলটা আসলে ১ বিলিয়ন বা ১.৫ বিলিয়ন ডলার। এইটা হচ্ছে ফ্যাক্ট। ৪০ বিলিয়ন ডলার হচ্ছে ফিকশান ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই লিস্টের বাহিরে কি ইনভেস্টমেন্ট নাই ? আছে। শি জিন পিনের এই সফর বাদেই বিভিন্ন সময়ে যে চুক্তি গুলো হয়েছে তার উপরে ভিত্তিতে, পায়রাতে ১.৫ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্টে ১৩২০ মেগাওয়াটের পাওয়ার প্ল্যান্ট হয়েছে যার ৫০% মালিক China National Machinery Import & Export Corporation (CMC) । সিএমসি ১.৫ বিলিয়ন ডলারে ৭০% মানে ১ বিলিয়ন ডলার ফিনান্স করেছে। এইটা বাদেও বাংলাদেশ পাওয়ার এবং এনারজি সেক্টরে, বেশ কিছু চাইনিজ ইপিসি কন্ট্রাক্টার রয়েছে। উদাহরনস্বরূপ। চাইনিজ ফার্ম SEPCOIII সিরাজগঞ্জে ৪১৪ মেগাওয়াটে পাওয়ার প্লান্টের ইঞ্জিনিয়ারিন প্রকিউরমেন্ট এবং কন্সট্রাকশানের কাজ করেছে।

বুঝতে হবে, ইপিসি কন্ট্রাক্ট কোন চাইনিজ ইনভেস্টমেন্ট নয়। এই প্রকল্পের ইনভেস্টর সিঙ্গাপুরের সেম্বকর্প ও নর্থ ওয়েষ্ট পাওয়ার কোম্পানী। চাইনিজ কোম্পানি ইপিসি কন্ট্রাক্টে কাজ করে, পয়সা নিয়ে চলে গ্যাছে।এখানে ইনভেস্টমেন্ট সিঙ্গাপুরের, চায়নার নয়। এই ধরনের ইপিসি কন্ট্রাক্টে পাওয়ার এবং এনারজি সেক্টরে বেশ কিছু চাইনিজ কম্পানি কাজ করে।কিন্তু, এই গুলোর ফিনান্স চায়না থেকে আসেনা তাই এই গুলোকে কোন মতেই চাইনিজ ইনভেস্টমেন্ট বলা যাবেনা। সেই হিসেবে করলে, পাওয়ার এবং এনারজি সেক্টরে মার্কিন জিই কম্পানির চায়নিজ কোম্পানির সমন্বিত ইনভেস্টমেন্ট থেকে বেশি ইনভেস্টমেন্ট আছে।

আমি আন্তাজে বলতেছি , (সময় থাকলে আরো স্টাডি করে ইনফরমেশান টা আপডেট করবো)- মেরে কেটে পাওয়ার এবং এনারজি সেক্টরে ১.৫ বিলিয়ন ডলারে উপরে ইনভেস্টমেন্ট পাবেন না।পোশাক শিল্পেও অনেক বেশি চাইনিজ ইনভেস্টমেন্ট নাই কারন, বাংলাদেশি মালিকেরা কম্পিটিশানের ভয়ে ইপিজেডের বাহিরে কাটিং মেকিং এবং সুইন এ ইনভেস্টমেন্ট বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু, সেই ডিটেলসে গেলাম না কারন ইমিডিয়েটলি তথ্য হাতে নাই। কিন্তু, আমি অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চিত হয়ে বলছি, উল্লেখিত প্রজেক্ট গুলো বাদে বাংলাদেশে চায়নার ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট খুব মিনিমাল একটা সংখ্যা হবে । বরং আমি দেখি জাপানিরা আরো এক্টিভ্লি ইনভেস্ট করছে।

তাই যদি সব গুলো সংখ্যা যোগ করি তবে আমরা পাই- এখন পর্যন্ত ইনভেস্ট হওয়া প্রজেক্ট গুলোর মধ্যে ছবিতে উল্লেখিত ১.৫ বিলিয়ন ডলার, পায়রা প্রকল্পে ১ বিলিয়ন ডলার(৭০% হিসেবে) এবং পাওয়ার এবং এনারজি সেক্টরে ১.৫ বিলিয়ন ডলার । মানে বিগত ৫ বছরে চায়না সর্বোচ্চ ৪ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট করেছে যা বাংলা টাকায় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

এইটা ডেবট ট্র্যাপ হওয়ার মত কোন সংখ্যা কিনা সেইটা বুঝতে হলে, আমরা অন্য একটা সংখ্যার সাথে তুলনা করতে পারি। বাংলাদেশ সরকার বিগত এক বছরে ব্যাঙ্কিং সিস্টেম থেকে ৭২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। https://bit.ly/2YmA4Ue। তার মানে, বিগত ৫ বছরে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বাংলাদেশে চাইনিজ ইনভেস্টমেন্ট, এক বছরে বাংলাদেশ সরকারের ব্যাঙ্কিং সিস্টেম থেকে নেওয়া ঋণের অর্ধেকের চেয়ে কম ।এইটা হচ্ছে ফ্যাক্ট। আর বাংলাদেশ চায়নার ৪০ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে, বাংলাদেশে চাইনিজ ডেবট ট্রেপে পরে যাচ্ছে বা ভারতকে কাউন্টার দেওয়ার জন্য বেল্ট এন্ড রোড ইনিসিয়েটিভে বাংলাদেশে চায়নার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার প্রোজেক্ট চলতেছে বা এই ধারনা গুলো হচ্ছে ফিকশান।

এই ফিকশান গুলোর একটা এক্সটেশন হচ্ছে, মতিউর রহমান সাহেবদের ওয়েট ড্রিমস, শেখ হাসিনার সামনে অগ্নিপরীক্ষা – কে কাকে বসায় রেখেছে, অথবা শ্যমল দত্তদের রচনা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ভারতীয় হাই কমিশনারের সাথে চার মাসে দেখা করে নাই।আমি বলছিনা এই গুলোর মাঝে ফ্যাক্ট নাই। ফ্যাক্টটা কি আমরা পরে দেখবো, কিন্তু, হালকা ফ্যাক্ট গুলো দিয়ে যে ন্যারাটিভ নির্মাণ হয় সেইটা একটা ফিকশান । কে কার সাথে দেখা করতে চার ঘণ্টা ওয়েট করেছিল, কে কাকে সালাম দেয় নাই এবং এই গুলোর ভিত্তিতে তারা যে ন্যারেটিভ নির্মাণ করেন, সেই ন্যারাটিভে তারা প্রশ্ন করেন না।

বাংলাদেশ যদি এতই চায়নার দিকে ঝুকেই যায় ? তবে চাইনিজ রাষ্ট্রদুতের মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রণালয়ে দৌড়াদৌড়ি এবং নিজে ভ্যাক্সিন নিবে এই সব গ্যারান্টি দেওয়া স্বত্বেও বাংলাদেশ সরকার চাইনিজ ভ্যাক্সিনের ট্রায়ালের অনুমতি দেয় নাই কিন্তু ভারতের দিকে ভ্যাক্সিন ভিক্ষার থালা বাড়ায় রাখছে ।এই সব ওয়েট ড্রিমসের ভিত্তি কি ? ফ্যাক্ট এবং ফিকশানের এই পার্থক্য গুলো আলোচনা গুলো থাকবে আগামি পর্বে । কিন্তু, আজকে একটা জিনিষ নিশ্চিত থাকি, বাংলাদেশের ৪০ বিলিয়ন ডলারের চাইনিজ ইনভেস্টমেন্ট এবং বাংলাদেশে চাইনিজ ডেবট ট্রাপ একটা মিথ। বাংলাদেশের ৫ বছরে চাইনিজ ইনভেস্টমেন্ট সরকারের এই বছরের ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণের অর্ধেকের চেয়ে কম। চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published.