সাম্য , মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার। তিনটা প্রিন্সিপালস। একটা রাষ্ট্র চালনা করার জন্যে দ্যাটস, এনাফ

আমি দুঃখিত যে , পারুল আপার রেফারেন্সে পাওয়া হেলাল মহিউদ্দিন ভাইয়ের, রাষ্ট্র-ভাবনায় তীব্রতম গলদ নামের তিন পর্বের এই আলোচনাটি নিয়ে চুপ করে থাকার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেয় নাই- যতই আমি সোশাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকতে চাই।

লেখা টা ভালো লেগেছে কারন, এই লেখায় একজন বোনাফাইড সোশিয়লজিস্ট একাডেমিশিয়ানের তরফ থেকে আমাদের অনেকের কিছু চিন্তার ভ্যালিডেশান পেলাম।

কিছু দিন আগে, জাকারিয়া ভাই পজিটিভিজমের কথা বলতেছিলেন ফয়েজ ভাই আর আমার সাথে একটা আলোচনায় । পজিটিভিজমের , রাষ্ট্রগঠনের একটা ফিলোসফি যেটা আসলে কোন সুনির্দিষ্ট আইডিওলজির উপরে নির্ভর করে না। যে মতাদর্শ থেকে যেই পলিসি এপ্রোপ্রিয়েট মনে হয় পজিটিভিজম সেইটা থেকে নেয়।

ক্যাপিটালিজমের নরডিক মডেল থেকে নেবো, জারমান সোশাল ডেমোক্র্যাসি মডেল থেকে নেবো, মার্ক্সবাদ থেকে নেবো, নৈরাজ্যবাদ থেকে নেবো , আমাদের ইতিহাস থেকে নেবো, নেপালের ইতিহাস থেকে নেবো – যে সেক্টরে যে পলিসি, আইডিওলজি, স্ট্রাটেজি আমাদের অভিজ্ঞতায় কার্যকর মনে হবে সেইটা আমরা পলিসি হিসেবে এডপ্ট করবো। এইটা হচ্ছে পজিটিভিজমের মূলনীতি। যে কোন স্পেসিফিক মতাদর্শের প্রতি দাসত্ব নাই।

আমি নিজেও গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আইডিওলজিস্টদের নিয়ে সমস্যা গুলো নিয়ে ভাবতেছিলাম। এবং আমার মনে হচ্ছিল যে, পজিটিভিজমের বিপরীত পথ হচ্ছে আইডিওলজিকাল পথ- অল আইডিওলজি, যে কোন আইডিওলজি । কারন, যে কোন সমস্যা সমাধানে আইডিওলজি একটা নির্দিষ্ট পথ আগে থেকে চিহ্নিত করে দেয় ফলে যার ফলে আইডিওলজিস্টরা আমাদের অভিজ্ঞতা এবং কান্ডজ্ঞান, বিবেক বুদ্ধি বাদ দিয়ে, তাদের আইডিওলজি থেকে সিদ্ধান্ত নিতে বলে- যার এপ্লিকেশান আরো বড় সমস্যা তৈরি করে।

কিন্তু পজিটিভিসিটদের যেহেতু কোন বাধা মতাদর্শ নাই, তারা কোন ধরনের বন্ধন বাদে নিজের অভিজ্ঞতা এবং সক্ষমতার ভিত্তিতে যে কোন সলুসশান নিতে পারে। যেইটা নিঃসন্দেহে অনেক বেশি কার্যকর।

পড়ে ভালো লাগলো যে হেলাল মহিউদ্দিন ভাই, আইডিওলজির এই ফাদ টাকেই রাষ্ট্র ভাবনার তিব্রতম গলদ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলতেছেন যে, একটা রাষ্ট্রের আইডিওলজির দরকার নাই। তিনি যে উদাহরন টা দিয়েছেন, ফুল ক্রেডিট টু মি, উনি নিজে না দিলেও আমি এই উদাহরন টা দিতাম। 😛 এই যে মনে করেন, বাঙালি জাতিয়তাবাদ এবং বাংলাদেশি জাতিয়বাদ বিতর্ক। এইটা আমাদের ঠিক কেন দরকার ? কেনই বা একটা রাষ্ট্রের জনগণের জন্যে সংবিধানে , জাতীয়তাবাদ চিহ্নিত করে দিতে হবে ?

আমি তো বলি, আমার কোন এক্সলুসিভ জাতিয়তাবাদই নাই। কারন, আমি জাতি হিসেবে বাঙালি, রাষ্ট্র হিসেবে, বাংলাদেশি, ধর্ম হিসেবে মুসলমান ।ফলে আমি একজন বাংলাদেশি বাঙালি মুসলমান। তিনটাই আমার পরিচয়। কোনটা থেকেই আমাকে বাদ দিতে পারবেন না ।

আমার আরো পরিচয় আমার বাড়ি চট্টগ্রাম যেইটার আলাদা একটা ভাষাভিত্তিক জাতিবাদি সম্ভাবনা আছে। মাইক্রসফটের চট্টগ্রামের ভাষার জন্যে আলাদা কি বোর্ড আছে দেখলাম। ফলে নাগরিককে আলাদা করে, এই জাতিয়তাবাদ নামের এই কাইজজা চাপিয়ে দেওয়ার মানেটা কি? আমি কোথাও ফর্ম পুরনে, তিনটাই লিখতে পারি। রেস- বাঙালি। ন্যাশ্নালিটি- বাংলাদেশি। রিলিজিয়ান- ইসলাম। আমার একটা আলাদা একটা জাতিবাদ কেন থাকতে হবে? অফিসিয়ালি আমাকে যে একটা মতাদর্শ নিতে বলা হলো, এই মতাদর্শিক বিতর্ক আমি খাবো নাকি গায়ে দিবো। আমি বাঙালি না বাংলাদেশি এই এই বিতর্কে কি লাভ হয় ?

আমি যখন বিদেশে ফরম ফিলাপ করি। আমাকে লিখতে হয় আমার রেস কি দেশ কি। কিন্তু আমার জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ কি সেটা তো কোথাও লিখতে হয় না।ফলে রাষ্ট্রকে নিয়ে যখন আমরা ভাববো তখন রাষ্ট্রের কোন ধরনের এক্সক্লুসিভ জাতিয়তাবাদের ই প্রয়োজন নাই। তাহলে আপনি বলতে পারেন, হায় হায় তাহলে রাষ্ট্র চলবে কেমনে ? রাষ্ট্র কিসের উপরে ভিত্তিতে সংবিধান তৈরি করবে ?হেলাল ভাই, সেইটা বলেছেন, আইডিয়ালস দিয়ে। উনি বলতেছেন, আইডিয়ালস এবং আইডিওলজি আলাদা জিনিষ। রাষ্ট্রের আইডিয়ালস থাকবে, আইডিওলজি থাকবেনা। রাষ্ট্রের কিছু মুলনিতি থাকবে।আইডিওলজি থাকার দরকার নাই। জনগণের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আইডিয়লজি থাকতে পারে। আইডিয়লজি নিয়ে কাইজ্জা থাকতে পারে।সেইটা নিয়ে রাজনৈতিক দল, মতাদরশিক দল প্রেশার গ্রুপ, এঞ্জিও, ধর্ম ভিত্তিক দল সব কিছু থাকতে পারে। কিন্তু, রাষ্ট্রের এই গুলো থাকার দরকার নাই।

অনেকে বলতে পারেন, তাহলে পরিচয়ের কি হবে ? গুড কয়েসচান। আমি মনে করতে পারি, আমি বাঙালি না আমি চিটাইঙ্গা। আপনি আমাকে ঠেকাইতে পারবেন ? আমি ঐতিহাসিক ভাবে দেখাইতে পারবো চিটাইনগারা বাঙালি না, তো কি করবেন ? ইউ সি রাষ্ট্র এই গুলো নিয়ে মাথা ঘামাবেনা। আমি নিজেকে চিটাইঙ্গা ভাবি নাকি বাঙালি ভাবি। নাকি চাকমা জানি। এইটা রাষ্ট্রের বিবেচ্য বিষয় না।

বিদেশে যারা গ্যাছেন, তারা অনেকেই আমেরিকায় গিয়া নাগরিকত্ব নিছেন। আমেরিকান হইছেন। ফাইন গুড। কোন সমস্যা নাই। আপনি আমেরিকান সিটিজেন হইছেন বলে, আপনার বাংলাদেশি বা বাঙালি বা মুসলমান পরিচয় কেউ কেড়ে নিতে পারবেনা। ফলে ঠিক পরিচয়ের জন্যেও যে, আইডিওলজি লাগবে এইটাও একটা ফাউ আলাপ , যেইটা শুধু শুধু আমাদের একটা অনন্ত বিতর্কে ঢুকিয়ে দেয়।

হেলাল ভাই বলতেছেন, রাষ্ট্রের দরকার কিছু আইডিয়ালস। হাই আইডিয়ালস যেমন, ইকুয়ালিটি এবং সোশাল জাস্টিস। কোন রাষ্ট্রের আইডিয়ালসে যদি থাকে ইকুয়ালিটি তাকে আলাদা করে কেন স্যাকুলার হতে হবে? আপনার ইকুয়ালিটি দিয়াই কি স্যাকুলারিজম কাভার করে যায় না ? রাষ্ট্র যদি ইকুয়ালি সকল নাগরিক কে দেখে, তার আলাদা করে সাকুলারিজম কেন লাগে। এই গুলো হইলো আইডিওলজির রাজনীতি। রাষ্ট্র যখন নিজে আইডিওলজিস্ট হয় তখন সে, পক্ষ বিপক্ষের রাজনীতি তৈরি করে, সন্ত্রাস এবং দমনের জাস্টিফিকেশান তৈরি করে মাত্র। ব্যক্তির আইডিওলজি থাকবে, দলের আইডিওলজি থাকবে দ্যাটস ফাইন। কিন্তু রাষ্ট্রের আইডিওলজি দরকার নাই। কিছু মূলনীতি থাকলেই হলো ।

খুব ইন্টেরেস্টিংলি, প্লেন লেট হওয়াতে একলা পেয়ে জিয়ার ডোমেস্টিক লাউঞ্জে ২০১১ কি ১২ সালে কামাল হোসেন সাহেবরে আমি এই প্রশ্নটা করেছিলাম । , যা মোবাইলে রেকরড করে সেই সময়ে সোশাল মিডিয়াতে দিছিলাম ও । উনারে কইছিলাম যে, সংবিধানের চারটা মুলনিতি কেন লাগে, শুধু মাত্র ইকুয়ালিটি দিলেই তো সব কাভার হইয়া যাইতো। উনি কি কি ব্লা ব্লা ব্লা বলছিলেন, সেইটা আবার লিঙ্ক খুজে দিবো। যদিও তখন আমার বয়স অনেক কাঞ্ছা ছিল এবং বিভিন্ন আইডিওলজির এতো লাথিগুতা তখনও খাই নাই কিন্তু, আমার কাছে উনার এই উত্তর টা বুলশিট মনে হইছিল। যদিও বাকি প্রশ্ন গুলোতে উনার প্রজ্ঞা আমাকে বিস্মিত করেছিল।

হেলাল মহিউদ্দিন ভাইয়ের তিন পর্বের এই আলোচনা এই জন্যে দারুন লাগলো কারন তিনি একটা আলোচনায় আমাদেরকে অনেক গুলো ট্র্যাপ থেকে আগে থেকেই সরায় দিলেন যে ট্র্যাপ গুলোতে পাবলিককে ঘোল খাইয়ে, বিভিন্ন বিতর্কের আফিমে বুদ রেখে এই ফ্যাসিজম আরো ৫০ বছর চলতে পারবে। গত কয়েক বছর ধরে আমি অনেক লোককে বলতে শুনেছি যে, এই ফ্যাসিজমকে পরাজিত করতে হলে বাংলাদেশকে ৪৭ এবং ৭১ এর প্রশ্নের মিমাংসা করে , নতুন আরেকটা ইউনিফাইং আইডিওলজি তৈরি করতে হবে । যে নতুন আইডিওলজি দিয়ে, আওয়ামি লিগের ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ধরনের ফ্যাকশনকে এক করতে হবে। এবং এই তৃতীয় ইউনিফাইং এই আইডিওলজি খুজে পাওয়াটাই হচ্ছে, বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় ইন্টেলেকচুয়াল চ্যালেঞ্জ।

হেলাল ভাইয়ের সাথে আমি একমত যে , আসলে এইটা আরেকটা ট্র্যাপ।আপনি যদি কিছু আইডিয়ালসে বিশ্বাস করেন, সেই আইডিয়ালস ফিরে পাওয়ার শর্ত তেই আপনি জনগণের মাঝে ইউনিটি তৈরি করতে পারেন, এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। কোন নতুন আইডিওলজি লাগবেনা। কারন আইডিওলজি কিছু মানুষকে যদি ইউনাইট করেও সেইটা আরো নতুন শত্রু নিরমান করে মাত্র। এইটা একটা অনন্ত বিতর্ক এবং লড়াই ও চিরস্থায়ী শত্রু নির্মাণের ট্র্যাপ। এইটা ঠিক যে মানুষের ইউনিটির জন্যে গল্পের এবং পরিচয়ের দরকার পড়ে। কিন্তু, এই আইডিওলজির ডিবেট একটা অন্তহীন ডিবেট। এইটার কোন মীমাংসা নাই। ফলে আসলে সেই থার্ড আইডিওলজি খুজে পাওয়ার কোন দরকার আমাদের নাই।

আমরা আইডিওলজি বিহিন কিছু প্রিন্সিপালের উপরে নির্ভর করেই, একটা রাষ্ট্রকে চিন্তা করে নিতে পারি, নতুন কোন আইডিওলজি আবিস্কারের প্রয়োজন নাই। আইডিওলজি বিহিন এই রাষ্ট্র ভাবনা অনেকের কাছে একটা বিশাল ধাঁধা বা খুবই নবীন পোস্ট মডার্ন চিন্তা মনে হইলেও দেখেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা পত্রেও কিন্তু, ঠিক এই ভাবেই চিন্তা করা হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা পত্রে ছিল, এই রাষ্ট্রের মুলনিতি হবে সাম্য , মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার। তিনটা প্রিন্সিপালস। একটা রাষ্ট্র চালনা করার জন্যে দ্যাটস, এনাফ। গুড গুড গুড এনাফ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.