আসুন রং চিনি। সাদা কালো এবং গ্রে কালার ।

গতকাল রাতে আমার ভারতীয় ইন্টেলেকচুয়াল বন্ধু গরগের ওয়ালে গিয়েছিলাম, ওদের দেশে কি অবস্থা তা জানতে। গরগ চ্যাটারজি কোলকাতায় খুব একটা প্রভাবশালী না হলেও, বাংলাদেশ বামপন্থী বুদ্ধিজীবী মহলে বেশ সারা ফেলেছে। তাকে মোটামুটি বাংলাদেশ হিতৈষী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
সে প্রায় প্রতিবছর , লিট ফেস্টে আমন্ত্রিত হয়। বক্তৃতা দিয়ে যায়। বছর কয়েক আগে, একজন কমন ইন্টেলেকচুয়াল বন্ধুর বাসায় গরগের সাথে আমি লাঞ্চ ও করেছি। আমার জানা আছে গরগের সাথে বামপন্থি বন্ধুদের অনেকেই কানেক্টেড।
সাম্প্রতিক কালে বাংলা পক্ষ নামের একটি আন্দোলনে গরগকে আলোচিত হতে দেখেছি। আমার ভালো লেগেছে এই ভেবে যে, একজন বাংলাদেশ হিতৈষী মানুষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
ফলে, স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ খারাপ রূপ নেওয়ার পরে আমি ভাবি অনেক দিন খোজ নেওয়া হয়না গরগ কি ভাবছে দেখি।
ওর ওয়ালে গিয়ে দেখলাম গরগ লিখেছে,
“তিস্তার জল বাংলাদেশকে আর বাংলার বরাদ্দ অক্সিজেন ইউপিকে দিতে চায় যারা, এই বাংলায় বহিরাগত, বহিরাগত তারা।”
একটা আন্তর্জাতিক নদী তাতে, গরগ যেভাবে তার অধিকার প্রকাশ করলো সেইটা আমাকে বিস্মিত করলো ।
গরগকে আমি কোলকাতর অগ্রসর এবং বাংলাদেশ বিদ্বেষ হীন মানুষ হিসেবে জানি। কিন্তু আমার মাথায় আবার আসছে বিষয় টা , যে গরগদের যদি এই অবস্থায় হয় সাধারণ মানুষের কি অবস্থা ?
ভারতে বাংলাদেশ ঘৃণাকে যেভাবে রাজনীতির মাধ্যেমে মানুষের মনস্তত্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে , এর থেকে মুক্তির কোন সুযোগ নাই।
ফলে ভারতীয় মনে , বিশেষত পশ্চিম বঙ্গ বাসিদের মনে বাংলাদেশ ঘৃণা একটা প্রকৃত বাস্তবতা- আমরা তাদের রাজনীতির আদার। আমাদের ঘৃণা করেই তাদের রাজনীতি পুষ্ট হয়। এই ফ্যাক্টকে উড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
গরগদের ঘৃণার রাজনীতির, এই শেডকে আমি চিহ্নিত করলাম কালো হিসেবে।
অন্য দিকে, ষ্ট্যাণ্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে চাকুরীর সুবাদে চেন্নাই য়ে থাকা কালীন সময়ে আমার কেরালা এবং চেন্নাইয়ের মানুষের সাথে পরিচয় আছে। এখনো বন্ধুত্ব আছে। আমি কখনই তাদের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে কোন বিদ্বেষ দেখি নাই।
প্রচণ্ড আন্তরিক এই বন্ধুদের কয়েক জন এখনো যোগাযোগ করে, বার্থডতে মেসেজ পাঠায়।
তাদের মধ্যে আমি কোন ধরনের বাংলাদেশ ঘৃণা দেখি নাই।
এই শেড টাকে আমি সাদা হিসেবে দেখলাম।
বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্তবাদ এবং ভারতীয় হস্তক্ষেপে দিল্লি নিয়ন্ত্রিত একটি শাসন ব্যবস্থা স্থাপনে জনগণের মনে যে স্বাভাবিক ক্ষোভ। এবং স্বাধীনতার পর থেকে ফারাক্কা সহ অভিন্ন সকল নদীতে পানি দিয়ে, সুজলা সুফলা বাংলার মরুকরণ , সীমান্তে হত্যা- সহ বিবিধ ইস্যু তে বাংলাদেশের মানুষের যে লেজেটিমেট ক্ষোভ তাকে প্রথম আলো ও বামপন্থী ঘরানার অনেক চিন্তক “ভারত বিরোধীতা” নামের একটি রাজনৈতিক শব্দ যুগলে বেধে রাখেন। এবং এই ইস্যুতে যে সকল ব্যক্তি রাজনৈতিক দল সরব তাদের ভারত বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেন।
এবং এই ধরনের ভারত বিরোধিতা যারা করে, তারা কত অনৈতিক, তারা কত বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী, তারা কত নাদান, তারা কত সাম্প্রদায়িক এই হিসেবে চিহ্নিত করার নিরন্তর প্রচারণা তাদের সকল লেখালেখিতে ফুটে উঠে।
দেশের মানুষের লেজেটিমিট ভারত নিয়ে ক্ষোভকে, “ভারত বিরোধী” নামের বর্গ উৎপাদন করে সেই গ্রুপকে ডিলিজিটিমাইজ করার এই প্রচারণাকে আমরা চিহ্নিত করবো হলুদ হিসেবে।
যদিও আমি বলেছি, আমরা সাদা কালো চিনবো। কিন্তু আসুন এই গ্রুপ টাকে আমরা হলুদ হিসেবে দেখলাম।
গত কাল রাতে বিবিসি, ডয়েচে ভ্যালে সহ বেশ কিছু নিউজে ভারতের হসপিটালে হসপিটালে প্রিয়জনদের মৃত্যুতে অসংখ্য মানুষের আহাজারির ভিডিও দেখে মনটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরছে।
আমার মনে হয়েছে, আচ্ছা আমরা কি কিছুই করতে পারি না ? পাকিস্তানের একটি ফাউন্ডেশান ৫০ টা এম্বুলেন্স দিতে চেয়েছে ? আমাদের যে আর্মির ফিল্ড এম্বুলেন্স ইউনিট গুলো আছে, এরা কি সাহায্য করতে পারে না ?
মনে হচ্ছিল,আহা পরাশক্তি, আহা আইপিএল, বম্বে ফিল্ম, বিলিয়নার, এট্ম বম্ব- কি রাষ্ট্র বানাইলা তোমরা চিকিৎসা না পেয়ে রোগী মরে যায়।
বাংলাদেশ যে ভারতে অক্সিজেন দিতে সক্ষম না। তা আমি সব সময়েই জানি। আমি তাই লিখেছিলাম, অন্তত পক্ষ ফিল্ড এম্বুলেন্স হসপিটালতো বাংলাদেশ সরকার পাঠাতে পারে।
তাই সেইটা লিখলাম। আমার লেখাতে কিছুই ছিঁড়ে না। কিন্তু, সেই স্ট্যাটাস এবং পরবর্তী স্ট্যাটাসে যে প্রতিক্রিয়া দেখলাম তাতে মনে হলো, বাংলাদেশের নতজানু পর রাষ্ট্র নীতি, গণতন্ত্রে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে পুতুল সরকার বসানো, সীমান্তে হত্যা, ৫৪ টা নদিতে বাদ দিয়ে মরুকরণ, সমুদ্র সীমানায় রাডার বসানো সহ সকল ধরনের সহজগিগতা সত্ত্বেও সামান্য তম শ্রদ্ধা এবং রেসিপ্রকেশান ফেরত না পাওয়াতে বাংলাদেশের মানুষের বড় একটি অংশের মধ্যে একটি ভয়াবহ মাস সাইকোসিস জন্মেছে।
আমাদের ঘৃণা আমাদের বিবেচনা বোধকে ছাপিয়ে উঠেছে। প্রশ্নটা নয় আমরা ভারতের বিপর্যয়ে কি করতে সক্ষম, খুব বেশী যে সক্ষমতা নাই তা সকলেই জানে – কিন্তু, ঘৃণা যখন আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে আধার করে দেয় আমরা বোধ বুদ্ধি হারিয়ে ফেলি। জাতি হিসেবে আমরা কোন সিচুয়েশানে আমাদের সাধারণ কমন সেন্স, মানবিকতাবোধ হারিয়ে ফেলতে পারি না। কিন্তু, ভারত প্রশ্নে অনেকের রেসপনস দেখে মনে হলো একটা ম্যাস সাইকোসিসে আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে বিগত ৮ বছরের রাজনীতি।
এই সময়ে স্যানিটি রক্ষা খুব কঠিন।
আমি এইটাকে কালো হিসেবে চিহ্নিত করলাম। এইটা দেখতে শুনতে জাস্টিফায়েড মনে হলেও এইটা জাস্টিফায়েড না।
আমার বন্ধু লিস্ট, আমার একটা গরব। আমার অনেক বন্ধু আমার চেয়ে ভালো জানে। কিন্তু আমার খুব চিন্তাশীল কিছু বন্ধুরাও আমার এই সাধারণ সহমরমিতার আহবানকে সমালোচনা করলেন।
বিশেষত আমাদের চিন্তাশীল মানুষেরও যদি এই ম্যাস সাইকোসিসে আটকে যাওয়াটা খুব খারাপ লক্ষণ।
এইটাকে আমি স্যাডলি কালো হিসেবে চিহ্নিত করবো। কজ, এইটাই ফ্যাসিসট চায়। এইটাই ফ্যাসিসট এবং ফ্যাসিট এপলজিস্টরা আমাদের মধ্যে খুঁচিয়ে উৎপাদন করতে চায়। আমাদের স্বাভাবিক চিন্তার ক্ষমতাকে বন্ধ করে, শুধু মাত্র আমাদের ফ্লাইট অর ফাইট রেসপন্স দিয়ে তাড়িত করতে চায়।
আই রিফিউয টু বি দ্যাট।
এই শেডটাকে আমি কালো হিসেবে চিহ্নিত করলাম।
একই সাথে আমার অনেক বন্ধু, ভারতকে হেল্প করতে চায়। তারা ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুতে অক্সিজেনের অভাবে সহমরমি। তাই আমাদের সক্ষমতা আছে কি নাই সেইটা না চেক করেই তাদের আহবান ভারতের জন্যে এক্সিজেন পাঠাও।
ইটা দেওয়ার সামর্থ্য যে আমাদের নাই। আমরা যে অক্সিজেন আমদানি করা জাতি এইটা তারা জানেন না।
কিন্তু, তাদের এই গুড উইলিংনেস এইটাকে আমি সাদা হিসেবে চিহ্নিত করি। এবং একটা বোকা সাদা হিসেবে দেখি কারণ তারা জানেনই না যে আমরা ভারত থেকে আমদানি করা দেশ। রপ্তানির বা সাহায্যের প্রশ্নই আসে না।
ফলে, এই অনেক গুলো সাদা কালোর হলুদের মধ্যে আমার গ্রে হচ্ছে, ভারতের অধিপত্ত্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের রেসপন্স হতে হবে একতা এবং নৈতিকতা । আমরা ওদের চেয়ে মহত্তর হবে। ওদের চেয়ে নিচু হবো না।
ভারতীয় আধিপত্তবাদ থেকে এবং ভারতীয় পুতুল সরকার থেকে মুক্তি কোন মতেই রিএকশনে নয়। একশনে।
সেই একশন হচ্ছে, নিজেদের মধ্যে ঐক্য। সেই একশন হচ্ছে একটা ভারতের চেয়ে মাথা উঁচু করে একটা জাতি হিসেবে উঠে দাঁড়ানো।
প্রতিক্রিয়াশিলাতা সব সময়েই আকর্ষণীয়। । এই ধরনের সময়ে, সব চেয়ে রিএকশনারি ধারনাকে সব চেয়ে আপন মনে হয়। কিন্তু সেই রিএক্সান কোন সমাধান দেয় না।
প্যালেস্টাইনকে দেখেন শেখেন, আমাদের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শেখেন।
আধিপত্ত বাদী শক্তির বিরুদ্ধে, শক্তি অর্জন করতে হলে সবার আগে একতাবদ্ধ হতে হয়।
তার চেয়ে বেশী, নৈতিক হতে হয়।
এই একতা এবং নৈতিকতা এই দুইটা বিসর্জন দিয়ে আধিপত্তের বিরুদ্ধে দুর্বলের অক্ষম প্রতিক্রিয়াশিলতা এবং অনৈতিক অবস্থান কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আনে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published.